অচঞ্চল জলে'র কবি ফারুক সুমন এবং তার কবিতা



কবি ফারুক সুমন সাহিত্য পাড়ায় দীর্ঘপথ হেঁটে অবশেষে মন দিয়েছেন কাব্যগ্রন্থ প্রকাশে। কবিতা লেখেন ২০০১ থেকে। বইমেলায় সাক্ষাতে প্রশ্ন করেছিলাম, 'এতো বিলম্বে কেন কবিতার বই প্রকাশ করলেন? "কবির বিনীত উত্তর "তুষ্ট হতে পারছিলাম না। এটাই বিলম্বের কারণ।" অবশ্য কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের আগে ২০১৫ এর গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয়েছে "শামসুর রাহমানের কবিতা: নগর-চেতনা ও নাগরিক অনুষঙ্গ" বইটি। যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় করেই আবির্ভূত হচ্ছেন-অনুমিতই ছিল। 


কবি যেন নিজেকে জেনে, নিজের শক্তিকে জেনে, নিজের সীমাবদ্ধতাকে জেনে তবেই জানান দিতে চেয়েছেন নিজের আগমনী বার্তা। হাঙর-কুমিরে ভরপুর জলে নামার আগেই কবি অকপটে স্বীকার করেছেন নিজের সীমাবদ্ধতা। ২০১৭ এর গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয়েছে তার কাব্যগ্রন্থ "অচঞ্চল জলের ভিতর নিরাকার বসে"। মূলত এই গ্রন্থের ব্যক্তিগত পাঠ-পর্যালোচনা হেতু এই লেখার অবতারণা। ফারুক সুমন গ্রন্থের কভারপৃষ্ঠায় আত্ম-উন্মোচন করেছেন এই বলে- 


'তোমরা যারা কবিতা লেখো

অথবা শব্দ কারিগর

আমাকেও ডেকে নিও

চিনিয়ে দিও কবিতাঘর।


আমার কোনো দশক নেই

জনহীন প্রান্তিকে -

আমি এক দলছুট কবুতর।


উঠে এসেছি হামাগুড়ি দিয়ে

কনুইয়ে কাদার দাগ

হাঁটুর বাটিতে কালো মতো কড়া

আমি তবে কোন দশকে যাবো?

সত্তর, আশি, নব্বই?

না, তাও নয়। তবে শুন্য!


এভাবেই দশক বিচ্ছিন্ন হয়ে

ভেসে বেড়াই মহাশূন্যে

অবর্ণনীয় বর্ণমালায় বিবৃত জন্মবৃত্তান্ত।


হে কবিতাদেবী! দশক চাই না

কবিতার দান দাও; দাও অমরতা

দাও বিমূর্ত মিনারের শুভ্র অবয়ব।"


কবিতা পাড়ায় তিনি শুধুমাত্র দলছুট কবুতর হলেও নিজেকে কোনো দশকে সীমাবদ্ধ রাখতে চান না। তিনি মহাকাল অভিমুখী। 


কবি ফারুক সুমন ‘অচঞ্চল জলের ভেতর নিরাকার বসে' কাব্যগ্রন্থের শব্দ প্রয়োগে স্বতন্ত্র হওয়ার চেয়ে কাব্যিক উপস্থাপনার দিকেই বেশি নজর দিয়েছেন বোধকরি। শব্দ, বর্ণ, ছন্দ-মাত্রা, রেফগুলোর সাথে স্থাপন করেছেন গভীর আত্মীয়তা। গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে তিনি কাব্য রচনা করেছেন এমনটি আমি বলতে যাবো না। তবে তিনি শব্দ, বর্ণ এবং রেফের সাথে যে আত্মীয়তা স্থাপন করেছেন, তা কবিতাঙ্গণে কবি ফারুক সুমনের স্বাতন্ত্র‍্যকে সুনির্দিষ্ট করবে। সেজন্যে বোধ করি, আমি অধমের তর্কে জড়াতে হবে না।


ফারুক সুমনের কবিতায় উপমা প্রয়োগের অভিনবত্ব চোখে পড়ার মতো। তার কবিতার মূল আগ্রহের জায়গা বোধকরি উপমা, রূপক ও চিত্রকল্পের আধারে ভাবকে ভাষার বুননে উপস্থাপন করা। এক্ষেত্রে একজন সচেতন কবির  মুন্সিয়ানা চোখে পড়ে। যেমন-


১. "ডানা ভাঙা খেঁজুর গাছের বিমূর্ত বিলাপ

আর শুকনো কলাপাতার করুণ কাতরানি"


২. "গাঁয়ের প্রান্তিকে স্তম্ভিত তেঁতুল গাছ"


৩. "তোমার কণ্ঠ বেয়ে শুয়ে আছে মাতামুহুরী নদী/ আপন ইচ্ছায় বইছে আর বইছে"


৪. "হিমায়িত কোনো দ্রব্যের মতো জমতে থাকি

আমাতে ভর করে নির্জন কোনো দ্বীপ"


৫. "তুমি নেই বলে,

এখন এখানে ধাতব সন্ধ্যা নামে।

রোবটিক বাতাসে ভারী হয় বুক

উৎকণ্ঠিত প্রতিটি মুখে শুধু

দুঃস্বপ্নের কানামাছি ওড়াওড়ি করে।"


তাঁর কবিতার পরতে পরতে এভাবে উৎকীর্ণ হয়ে আছে কাব্যিক সুষমা ও সৌন্দর্য্য। তার লেখা পড়ে পাঠক কবিতার স্বাদ আস্বাদন করবেন সন্দেহ নেই। 


এ কাব্যগ্রন্থে কবি চেনা শব্দগুলোকে দান করেছেন আলাদা মাত্রা। ‘ভুলে যাওয়া মানে মনের খুব গভীরে তুলে রাখা' ‘নীরবতা মানেই নিস্পৃহতা নয়' ‘দুরত্ব মানেই বিমুখতা নয়' 'প্রতীতির প্রজাপতি পাখা ভেঙে পড়ে গেছে জলে' –এমন প্রকাশভঙ্গী শব্দগুলোকেই চিনিয়েছে নতুন করে।


এ কাব্যগ্রন্থে কবিকে বহুমুখী চেহারায় পেয়েছে পাঠক। কবি কখনো প্রেমিকার গভীর প্রেমে মগ্ন। আবার কখনো দারুণ অভিমানী হয়ে বলেছেন-


'প্রতীক্ষায় রেখে

যে তুমি চলে যাও বাহানার মোড়ে

কবিও কম নয়;

মুখ ফিরিয়ে চুরুট ধরায় বৈশাখী ঝড়ে।

কবিদের অভিমান রক্ত লাল কোকিলের চোখ। (কবিদের অভিমান) 


আবার এটাও লেখেন-


"আমি মরে মরে সরে আসি

ভালোবাসি নিভৃত জলের গান।


আমার পরিচয়-

ভালোবাসায় বলি হওয়া

ভেসে যাওয়া প্রেম অফুরান।" 

(আমি মরে মরে সরে আসি)


"অচঞ্চল জলের ভিতর নিরাকার বসে" কাব্যে একজন সময়-সচেতন কবির সন্ধান পাওয়া যাবে। তার কবিতায় সভ্যতার বন্দনা রয়েছে। কবি টি. এস. এলিয়টকে চেনাচ্ছেন যান্ত্রিক শহরের পরতে পরতে থাকা সভ্যতার চিহ্ন। দেখিয়েছেন এই শহর ঢাকার সাহিত্যভুবন।


"আসুন আসুন, এইতো শাহবাগ-

আপনি হাসছেন?

হাসতে হাসতে কাশছেন? 

শাহবাগের মোড়ে মোড়ে কবিতা বিতান।

কবিতার পাতা জুড়ে কবিদের শিথান।" 

(কবি টি.এস.এলিয়ট)


আবার কখনো সভ্যতা ও মানবতার অধঃপতন দেখে প্রতিবাদ করে লিখেছেন-


"সভ্যতার সবগুলো বাতি নিভিয়ে দাও

আঁধারে ডুবে যাক আকণ্ঠ

প্রাচীন এই পৃথিবী।" (জরাজীর্ণ ইতিহাস) 


শান্ত ভাষায় বিদ্রোহের গান এর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে!


কবি ফারুক সুমন তাঁর লেখায় কবিতার আড়ালে রচনা করেন এক একটা আখ্যান। বেশকিছু কবিতায় আখ্যানের আঙ্গিকে চমৎকার কবিতা সৃষ্টি করেছেন। প্রান্তিক নারী জমিলারা হয়ে ওঠেন সেসকল আখ্যানের নায়িকা!


"জমিলা এখন জংশনে পড়ে থাকা কলার ছিলকে

কত কেউ পিছলে পড়ে তাতে

বিবশ দেহ নিয়ে ঘুমভাঙা রাতে।

......   .........      ...... ...

এখন জমিলার জীবনে জানালা নেই

রুদ্ধতার অভিশাপে অর্ধমৃত

তবুও

সকাল সন্ধ্যা স্বপ্ন দেখে

হৃদয়ের ছবি আঁকে। "  (কবিতা নয়; আখ্যান) 


"অবদমনের আলপিন" কবিতাও আখ্যানধর্মী কবিতার উজ্জ্বল উদাহরন।


একজন কবি কখনোই সমকাল কিংবা সমাজবিচ্ছিন্ন হতে পারেন না। সমসাময়িক নানা অস্তিরতা ও সংকট ফারুক সুমনের কবিতায় কাব্যিক ভাষায় প্রকাশ পেয়েছে। তার লেখা "আতরের সৌরভ", "অসমাপ্ত প্রতিবেদন", "নিশ্চিন্ত মানুষের ধারাবিবরণী", "জরাজীর্ণ ইতিহাস", "রক্তাক্ত শিক", "কুৎসিত দাঁড়কাকে খায় যাবতীয় পাকা আম" এবং "ডিমের খোসার ভেতর চুপচাপ বসে থেকে", ইত্যাদি কবিতায় বিশ্বব্যাপী জঙ্গি উন্মাদনা, সাম্প্রদায়িক অস্থিরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে। যেমন- 


"গৌরবের দড়িদড়া ছিঁড়ে দাঁড়িয়েছ পথের কিনারে

হে উদ্ভিন্ন ব্রতচারী-

সফেদ জামার আস্তিনের নিচে রক্তাক্ত ছুরি

ভেসে আসছে আতরের সৌরভ

------    ------ ------    ------

হে ভণ্ডব্রতচারী

তোমার গৌরব আর আতরের সৌরভের দোহাই-

আর কত রক্তস্রোতে গা গলিয়ে

খুঁজতে যাবে বেহেস্তের বাড়ি?"


পরিশেষে বলবো, ফারুক সুমনের কবিতায় নান্দনিক শিল্পসুধা পাঠক অবশ্যই গ্রহণ করবেন। কারণ, কবিতাগুলোর পঙক্তিজুড়ে মানুষের অন্তর্গত কথা, আশা-নিরাশা কথা, প্রেম-প্রতারণা এবং সমকালীন অস্থিরতার কথা এসেছে। কবি, শুভকামনা রইলো। আমৃত্যু কবিতা লিখুন। আমাদের জন্যে। ভক্তপাঠকের জন্যে। ভালবাসা।

Post a Comment