মগ্নপাঠ পত্রিকার পোস্টমর্টেম

 



কোন একটা পত্রিকা প্রকাশ পেলে তার গেটআপ-মেকআপ লেখক তালিকা সব ছাপিয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে তার চরিত্র। পত্রিকার চরিত্র কীভাবে নির্ধারণ হবে সে আলোচনায় যাওয়ার আগে খাবার পানি আমরা কীভাবে ঠিক করি সে আলোচনা করা যাক। প্রথমেই আমরা পানির বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য বা এপিয়ারেন্স দেখি- স্বাদ, গন্ধ ঠিক থাকলে তারপর নিশ্চিত হওয়ার জন্য তাত্ত্বিক নানা দিক পিএইচ, গলনাংক, স্ফুটনাংক, ট্রেস এলিমেন্ট মিজারমেন্ট ইত্যাদি দেখে। শুরুতেই আমরা ল্যাবরেটরি টেস্টের জন্য বসি না। পত্রিকার চরিত্রের ক্ষেত্রেও বিষয়টি অনেকটা এমনই- প্রথম বিষয় এপিয়ারেন্স এবং তারপর আসবে তাত্ত্বিক আলোচনা। পত্রিকার বাহ্যিক দিক বলতে এখানে লেখক তালিকা বা গেটআপ-মেকআপকে যে বুঝানো হচ্ছে না সে কথা আমি শুরুতেই বলে এসেছি। একটা পত্রিকার প্রথম এবং শেষ বিষয় লেখা এবং বাকি সকল কিছু আনুসঙ্গিক- না থাকলে বিশেষ ক্ষতি হবে না। পত্রিকার বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য বা এপিয়ারেন্স হলো লেখাগুলো কীভাবে সাজানো হয়েছে। এখানে আপনার মনে হতে পারে- পত্রিকার গেটআপকে আনুসঙ্গিক বলে লেখা কীভাবে সাজানো থাকবে, তাকে মৌলিক ব্যাপার বলার মানে কী? এই ব্যাপারটা এজন্যেই গুরুত্বপূর্ণ- আপনাকে খিচুড়ি খাবার আমন্ত্রণ দিয়ে যদি অগোছালোভাবে চাল, ডাল, আলু, সবজি, মশলা ইত্যাদি ধরিয়ে দেওয়া হয়- আপনি নিশ্চয়ই ব্যথিত হবেন। সাহিত্য পত্রিকা হচ্ছে একটা খিচুড়ি- এবং সে খিচুড়ি কত সুন্দরভাবে রান্না হবে তা নির্ভর করবে সম্পাদকের উপর। ‘মগ্নপাঠ’ পত্রিকার আলোচনা করতে বসে এত কথা বলার মানে একটাই- আমি পত্রিকাটির চরিত্র ধরতে চাইছি। এখন অবশ্য পত্রিকার চরিত্র নিয়ে কারোরই তেমন মাথাব্যথা নেই। পত্রিকার আলোচনাও খুব একটা দেখা যায় না। বাংলা একাডেমির লিটলম্যাগ চত্ত্বর ফাঁকা থাকে- একুশে ফেব্রুয়ারি কিংবা ভ্যালেন্টাইন ডে তে যেখানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পা ফেলার জায়গা থাকে না- সেখানে লিটলম্যাগ চত্ত্বরে পুট্টিফিকেট ডিকম্পোজড বডির উপর যেমন মাছি ওড়ে- তেমনভাবে মাছি ওড়ে- পত্রিকা কেনেন বন্ধুস্থানীয় লোকজন, না কিনলে মাথা কাটা যায় বলে-! 


এতকিছুর ভেতর নতুন পত্রিকা বেরুচ্ছে এটা আমাদের আশাবাদী করে তোলে- এ আশাবাদ আরও বাড়ে সম্পাদকীয় এবং প্রচ্ছদ গদ্যে। এ সময়ে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক সম্পাদকীয় আমাদের নিজের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। প্রচ্ছদ গদ্যে জাকির তালুকদার নন্দনতত্ত্বের রাজনীতির সমালোচনা করে লিখেছেন- “একালের সমালোচকরা রবীন্দ্রসাহিত্যে পায় ‘বুর্জোয়ামি’, আবার কেহ কেহ ‘রাশিয়ার চিঠি’- লেখকের ভেতর সাম্যবাদী গন্ধও পেয়েছে। ‘রক্তকরবী’র ভেতর মার্কস আবিষ্কার করতে কেউ কেউ রাজি। সেকাল-একালের কেহ কেহ রবীন্দ্র-সাহিত্যে দুর্নীতির বিশ্বকোষ পেয়ে থাকে। ঠিক উল্টো ব্যাখ্যাও বাজারে চলেছে চিরকালই। ...সমালোচকদের মর্জিমাফিক কতগুলো মন-গড়া রবীন্দ্রনাথ দাঁড়িয়ে গেছে।” পুরো প্রবন্ধে আদর্শ সমালোচকের বৈশিষ্ট্য খুঁজে বের করতে তিনি বিনয় সরকারকে কোট করেছেন, দৈবচয়নের মাধ্যমে ফ্রান্সিস কাফকাকে দিয়ে নন্দনতত্ত্বকে খারিজ করার চেষ্টা চালিয়েছেন এবং পরবর্তীতে অস্তিত্ববাদের বিরোধিতা করেন। লেখেন- “মূল নান্দনিক প্রবক্তা জ্যাঁ পল সার্ত্র-র হাইপোথিসিস নিজেই এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে অনকাংশে। যেখানে সাহিত্য বলতে কী বোঝায়, তা সার্ত্র-র মতে- ‘লেখা জীবন নয়’। প্লেটোনিক সারবত্তা অনুধাবনের জন্য অথবা সৌন্দর্যের আদর্শ সম্বন্ধে: চিন্তা-ভাবনার জন্য জীবন থেকে পলায়নও নয় সাহিত্য” গেওর্গে লোকাচ ও ব্রেখট এর বিতর্কের মাধ্যমে কমিউনিজমে এর সাথে এস্থেটিকস এর দ্বন্দ্ব ও সর্বোপরি দুই মতবাদেরই বিরোধিতা করেছেন। পুরো ব্যাপারটাকে খারিজ এর চেষ্টা করেছেন বলছি এই কারণে যে- খারিজ করার যুক্তিগুলোর একপেশি মনোভাবের কারণে। সাহিত্যের রাজনীতির বলয় যখন আমাদেরকে মাগিং এর মতো চেপে ধরেছে- সে সময়ে জাকির তালুকদার এর গদ্যটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হলেও আমাদের পুরোপুরি সিদ্ধান্তে দাঁড় করায়নি- বরং নিজের যুক্তিগুলোকে কোননোরূপে ঝেড়ে দিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচলেন এমন বোধ হলো।


প্রথম ধাক্কা খেলাম- গোলাম কিবরিয়া পিনু’র ‘প্রগতিশীল নন্দনতত্ত্ব ও লেখক শিল্পীর ভাবাদর্শের লড়াই’ প্রবন্ধে। প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক আনাতোলি ইয়েগেরোভকে কোট করেই নিজের দায়িত্ব শেষ করেছেন। পরবর্তী আলোচনায় তিনি দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন- পেরেছেন কিনা তা পরের বিষয় হলেও ভাবদর্শের লড়াইয়ের কিছইু সেখানে পাইনি- যা আমাকে হতাশ করেছে। 


কাকচক্ষু কবিতার খোঁজে শিমুল মাহমুদ কিছু পুরনো ঘাষ চর্বন করিয়েছেন। পারসেপশান ক্রিয়েট না করে পুরনো সংজ্ঞাগুলোকে ঘুরিয়ে লেখার প্রবণতা থেকে বেরুতে পারেননি তিনি। এখানে অবশ্য শিমুল মাহমুদকে আমি বরং ডিফেন্ডই করছি- কবিতার সংজ্ঞা এতো বছরে এতোভাবে দেয়া হয়েছে- সেখান থেকে নতুন পারসেপশান ক্রিয়েট করা কষ্টকরই(!) বটে। প্রবন্ধে তিনি ভাষাগত দিক দিয়ে কিছু ম্যাজিক্যাল মোমেন্ট ক্রিয়েটের চেষ্টা করেছেন- শেষ পর্যন্ত তা ওই ভাষাগত ব্যাপারেই আটকে গেছে। 


প্রচ্ছদ এবং বিষয়বস্তু দেখে মনে হচ্ছিল এ পত্রিকার চমক হবে প্রবন্ধ। কিন্তু তা হতে হতে না হবার পর- চমক হিসেবে চমকে দিয়েছে কবিতা। যে কোন পত্রিকার জন্য জরুরী ব্যাপার হলো সমসাময়িক সাহিত্যের পালস্ ধরতে পারা। যে কোন সময়ের চেয়ে দ্বিতীয় দশকের কবিতার পালস্ মনে হচ্ছে হাইপোভলিউমিক আর কিছুটা এসিমেট্রিক। বিগ ম্যাগগুলো কবিতার এ পালস্ বদলকে অস্বীকার করার প্রবণতার ফলে গুরুদায়িত্ব বর্তায় সাহিত্য পত্রিকাগুলোর উপর। সেখান থেকে ‘মগ্নপাঠ’ চমৎকার কাজ করেছে। শব্দের ভাঙা-গড়ার ভেতর থেকে বেশ কিছু কবিতা মগজে অনুরণন তুলেছে। ঝিমুতে ঝিমুতে চিন্তার ভেতর থেকে কোন সরীসৃপ বের হয়ে প্রলাপ বকতে শুরু করে। ‘তিনপর্বে’ বিভক্ত কবিতার প্রতিটি পর্বেই বিভিন্ন পালসের কবিতা আছে যা থিংকিং প্রসেসকে হাই জাম্প দেয়াচ্ছে। ভিন্ন স্বাদের কবিতা মার্জ  করার ক্ষেত্রে যে চ্যালেঞ্জ থাকে তা বেশ দারুণভাবেই উতরে গেছেন সম্পাদক।


এ পত্রিকার একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য এর কলেবর- তা শুধু পেইজে নয়- শিল্প সাহিত্য এমনকি ইতিহাস নিয়ে লেখাও রয়েছে। রিঙকু অনিমিখি এর প্রবন্ধে সুনিপুণভাবে ইতিহাসের অসঙ্গতি উঠে এসেছে। অনুবাদে চেনা ফাঁদ- বাক্যের দুর্বোধ্যতা রয়ে গেছে। লেখক গুগল-ট্রান্সলেটর হয়ে উঠলে বিপদ। ব্যাপারটা বেশ কর্কশ শোনলেও এটাই সম্ভবত সত্যি! বাংলা সাহিত্যে অন্তত সাম্প্রতিক সময়ে যে অনুবাদ হচ্ছে তা পড়ে মূল রচনার যে ভাব তার ধারে কাছে তো ঘেঁষাা যায়ই না বরং অনেক বিখ্যাত লেখা সম্পর্কেও বিরক্তি তৈরি হয়। মোহাম্মদ সালাহউদ্দীন অনুবাদে লিখেছেন- “ মহিলাটি দাঁড়িয়েছিল মিশরের একটা জাদুঘরের প্রধান ফটকের ছাদের উপর। সবাই স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। কিন্তু কেউই জানে না সে কীভাবে সেখানে উঠেছে। কিছুক্ষণ পর তাকে দেখে মনে হয়েছে, সে এখনই সেখান থেকে ঝাঁপ দেবে।” এ অনুবাদটি কি আরেকটু প্রাঞ্জল ভাষায় হতে পারতো না? সম্ভবত যারা অনুবাদ করেন তাদের মধ্যে একটা ব্যাপার দাঁড়িয়ে গেছে- অনুবাদ প্রাঞ্জল হয়ে উঠলে তার ভ্যালু কমে যায় (!)


একটা ব্যাপার ভালো লেগেছে- সাম্প্রতিক সময়ে কোন পত্রিকায়ই মনে হয় নাটক ছাপা হয় না। এ সংখ্যায় একটা নাটক আছে- পড়ে ঝরঝরে লেগেছ। নাটকের সাফল্য নির্ভর করে ডিটেইলিং এ। যেদিক থেকে নাটকটাকে স্বার্থক বলা যায়।


আর যা আছে তা কারো আগ্রহ থাকলে সূচীতে চোখ বুলালেই টের পাওয়া যাবে। সূচী তুলে দেয়া বা পত্রিকার ধারাভাষ্য করা কোনটাই আমার কর্ম নয়। সেসব লেখাও উপরের আলোচনার ছকে ঢুকে যাবার সম্ভাবনা থাকায় তা নিয়ে আলোচনায় যাচ্ছি না। এখানে বাজে কাজ যা হয়েছে- বাকি সবগুলো লেখাকে ছকে ফেলে দেয়া হয়েছে। ছক যে কোন কিছুর জন্যেই বিপদজনক- কিন্তু এও তো স্বীকার করতে হবে- পত্রিকা একটা সুসম্পাদিত ব্যাপার আর সম্পাদনা কোনো না কোনো ছকেই হয়- সচেতন পাঠকমাত্রই ছক ধরতে পারবেন। 


অনেক কথা বলা হলো- আবার শুরুর আলোচনায় ফিরি- মগ্নপাঠ পত্রিকার চরিত্র কী দাঁড়ালো তাহলে? সত্যি বলতে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো চরিত্রই দাঁড়ায়নি। এবস্ট্রাক্ট কিছু চরিত্র ধারণ করার চেষ্টা করেছে- কিন্তু শেষ পর্য়ন্ত সেও ডেফিনিট হয়ে ওঠেনি। তরল পদার্থের বৈশিষ্ট্য এমনভাবে আছে, পদার্থটা পানি হতে পারে আবার কেরাসিনও হতে পারে। এপিয়ারেন্স এর পর তত্ত্বের আলোচনায় গেলে প্রবন্ধগুলোকে আমার আধুনিক ঘরানার মনে হয়েছে। অনেকাংশেই মনে হয়েছে- লেখক কোন ঝুঁকি নিতে চান নি- যুক্তি দিচ্ছেন সেও খুব সাবধানে- পাছে আবার কেউ কষ্ট না পেয়ে বসে!


মগ্নপাঠ পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যাটি খুবই সমৃদ্ধ একটা সংখ্যা। নানা ধরণের লেখা এমনভাবে বিন্যস্ত করা হয়েছে- সুখপাঠ্যই বলা চলে। আমার এই ভেবে কষ্ট হচ্ছে- এতো সমৃদ্ধ একটা সংখ্যাকে কোনো চরিত্রে ফেলা যাচ্ছে না- আর নির্দিষ্ট চরিত্র ধারণ করার অক্ষমতার জন্য সংখ্যাটিকে একটি নিখাদ সংকলন বলতে হচ্ছে। তবে আমি নিশ্চিত, নিখাদ সংকলন হলেও এই সংখ্যাটি দীর্ঘদিন পাঠকের তৃষ্ণা মেটাবে। 


Post a Comment