চৌধুরী ফাহাদ - এর সাথে আলাপ

 [ বইমেলা ২০২০ উপলক্ষে মিহিন্দার সাথে কথা বলেছেন কবি ও চন্দ্রবিন্দু প্রকাশনীর প্রকাশক চৌধুরী ফাহাদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, রাফাতুল আরাফাত ]




মিহিন্দা:  ফাহাদ ভাই, কেমন আছেন?
চৌধুরী ফাহাদ : ভালো আছি রাফাতুল আরাফাত। শুভেচ্ছা আপনাকে।

মিহিন্দা : বইমেলাকে কেন্দ্র করে চন্দ্রবিন্দুর আয়োজন সম্পর্কে জানতে চাই। চন্দ্রবিন্দু থেকে এবার কয়টা বই আসছে?
চৌ. ফা :  আপনি হয়তো জেনে থাকবেন চন্দ্রবিন্দু পারস্পরিক সময়ের যুগলবন্দী করার চেষ্টা করছে। চন্দ্রবিন্দু প্রকাশিত বইয়ের দিকে থাকালে ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন। সময়ের তরুণ তুর্কি অথচ লেখনিতে ঋদ্ধ এবং বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করা বেশ ক'জন সিনিয়র লেখকদের বই নিয়ে কাজ করছে চন্দ্রবিন্দু। এবারের বইমেলায় এই মেলবন্ধনের প্রায় ৫৫ টি বই নিয়ে এসেছে চন্দ্রবিন্দু।

মিহিন্দা :  গত বইমেলায় অন্যান্য বইয়ের পাশাপাশি কবিতার বই দিয়ে চন্দ্রবিন্দু পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সামর্থ্য হয়েছিলো। এবারও কি সুনির্দিষ্ট কোন পরিকল্পনা আছে?
চৌ. ফা : ২০১৯ সালের বইমেলায় আমাদের মুল ফোকাস ছিল কবিতায়। সম্ভবত আমরাই সবচেয়ে বেশি নতুন স্বর পাঠকের সামনে তুলে ধতে পেরেছি কবিতায়। এবারের বইমেলায় একদম ভিন্নস্বরের গল্পের বই নিয়ে এসেছি আমরা, সেই সাথে দারুণ কিছু উপন্যাস আছে যেগুলো এসেছে সময়ের প্রতিষ্ঠিত কথা সাহিত্যিক ও কিছু তরুণ লেখকের সতেজ কলম। এবং কবিতায় দারুণ কিছু নতুন মুখ যারা অনেকদিন ধরে কবিতায় আছেন কিন্ত বই আকারে আসছে প্রথমবার। এরবাইরে কবিতা ও সিনেমা বিষয়ক প্রবন্ধ নিয়েও কাজ করেছি আমরা। মোটামুটি সাহিত্যের সব স্থর নিয়েই আমরা কাজ করছি...

মিহিন্দা : প্রকাশনীগুলোর বিরুদ্ধে যে অভিযোগটা বইমেলায় থাকে - সময়মতো বা মেলার শুরুতে বই আনতে না পারা। চন্দ্রবিন্দুর বইগুলোর কাজ কী পর্যায়ে আছে? পাঠকরা কি মেলার শুরু থেকেই বইগুলো পাবে?
চৌ. ফা : এই ব্যাপারে চন্দ্রবিন্দু প্রথম থেকেই সচেতন ছিল এবং থাকবে। আমরা বইমেলাকে কেন্দ্র করে প্রায় ৪/৫ মাস আগে থেকেই পাণ্ডুলিপি নিয়ে কাজ শুরু করেছি। যার ফলস্বরূপ চন্দ্রবিন্দু প্রায় সকল বই মেলার প্রথম দিনেই নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে।

মিহিন্দা :  নতুন প্রকাশনীগুলোর অধিকাংশই মেলা কেন্দ্রিক। মেলাকে কেন্দ্র করেই যাবতীয় পরিকল্পনা। বাকি সময় প্রায় কোন কাজই চোখে পড়ে না। চন্দ্রবিন্দু'র ক্ষেত্রেও কি সেরকম হবে?
চৌ. ফা : এটা কেবল নতুন প্রকাশনী নয়, সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হয়ত। কারণ আমাদের প্রকাশনা শিল্পের বাজারটাই গড়ে উঠেছে বইমেলাকে কেন্দ্র করে। সারাদেশের পাঠকরাও মূলত বইমেলার দিকে তাকিয়ে থাকে। এরপরেও অনেক প্রকাশনী বইমেলার বাইরেও বই প্রকাশ করছে, যেগুলো আয়োজন কেন্দ্রিক নয় বলে সেভাবে প্রচারের আলোয় আসছে না, পাঠকরা জানতে পারছে না। কাজ হচ্ছে, কাজ হবে। আমরাও বইমেলার বাইরে বই নিয়ে কাজ করেছি, বই করেছি। বেশ অনেকগুলো বই'ই আমরা বছরের মাঝামাঝি সময়ে করেছি, বইমেলায় প্রদর্শিত বইয়ের দিকে তাকালেই আপনি দেখতে পাবেন। আমরা সারাবছর বই নিয়ে কাজ করতে চাই। এবং করবো...

মিহিন্দা :  প্রকাশনীগুলো মেলা কেন্দ্রিক হয়ে যাওয়াতে প্রকাশনা শিল্পই কি হুমকিতে পড়ছে?
চৌ. ফা : আমরা আয়োজন প্রিয় জাতি। তাই আমাদের সকল উৎসাহ-উদ্দীপনা উৎসব কেন্দ্রিক। তাই উৎসবের বাইরের সময়টা আমাদের চোখের আড়াল রয়ে যায়। এই কারণে প্রকাশনী সমূহও কিছুটা বইমেলাকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। এই বিষয়ের উত্তরণ জরুরী। সারাদেশে, বিশেষত প্রতিটি জেলায় সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। এই বইমেলাকে ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রিক না রেখে ছড়িয়ে দিতে হবে ক্যালেন্ডার মাফিক। তাতে করে সারাবছর বইপ্রিয় পাঠকের উৎসাহ থাকবে এবং ফেব্রুয়ারি তথা বইমেলা কেন্দ্রিক না হয়ে প্রকাশনী ও লেখক সারাবছর বই প্রকাশ করতে উদ্বুদ্ধ থাকবেন।

মিহিন্দা : চন্দ্রবিন্দুর এই নিয়ে দ্বিতীয় বইমেলা। বইমেলার অভিজ্ঞতা কেমন?
চৌ. ফা : হ্যাঁ। চন্দ্রবিন্দু এবার দ্বিতীয়বারের মতো বইমেলায় হাজির হয়েছে, যদিও প্রকাশনা শিল্পে চন্দ্রবিন্দুর বয়স প্রায় তিনবছর। অভিজ্ঞতা ব্যাপার সময়ের সাথে সাথে বাড়ে। এটা কোথাও স্থির নয়। বইমেলায় প্রতি বছর নতুন নতুন অভিজ্ঞতা হবে। এটা একটা কন্টিনিউয়াস প্রসেস...

মিহিন্দা : ছোটকাগজ থেকে প্রকাশনী। চন্দ্রবিন্দুর গল্পটা শুনতে চাই।
চৌ. ফা : আমারা বন্ধু 'মঈন ফারুক' প্রায় একযোগ ধরে ছোটকাগজ 'চন্দ্রবিন্দু' করে আসছে। এক সাথে পথ চলতে চলতে, ফুটপাথ ও চায়ের কাপে আড্ডা দিতে দিতে আমি ও আমরা জুড়ে গেলাম চন্দ্রবিন্দুর সাথে। বেশ অনেকটা সময় আমরা আলাপ-আলোচনা ও আমাদের বন্ধুস্থানীয়দের সাথে পরামর্শ করে দীর্ঘ সময় নিয়েই প্রকাশনা শিল্পে এসেছি। চন্দ্রবিন্দু একটা টিম। যার পেছনে কাজ করছে একদল তরুণ অথচ অভিজ্ঞতায় স্পষ্ট। বলতে পারেন আমরা প্রস্তুতি নিয়ে এসছি, দীর্ঘ পথ এক সাথে হাঁটবো বলে...

মিহিন্দা : চন্দ্রবিন্দু প্রবীণদের পাশাপাশি নতুনদের নিয়েও কাজ করছে। পাঠকরা নতুনদের কীভাবে গ্রহণ করছে?
চৌ. ফা: বর্তমানের নতুনরাই একদিন প্রবীণ হয়। সাহিত্যে নবীন-প্রবীন ব্যাপারটা খুব একটা স্থুল মনে হয়না আমার। বয়সে নবীন বলেই কারো লেখনী কাঁচা হবে এই ধারণা ঠিক যুতসই লাগে না। চিন্তা ও প্রকাশে ক্ষুরধার হলে স্পষ্টতই যে কোনো লেখক জায়গা করে নিতে পারেন সাহিত্যে। এবং তাঁর গ্রহনযোগ্যতা সময়ের ব্যাপার মাত্র।

মিহিন্দা :  নতুনদের থেকে একটা অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়, নতুনদের বইগুলো স্টলে প্রদর্শনের ক্ষেত্রে প্রকাশকদের অনীহা দেখা যায়..এ অভিযোগ কতটা সত্য?
চৌ. ফা :  আমার মনে হয়না এমন কেউ করছে। বইমেলায় স্থান সংকুলানের একটা ব্যাপার আছে, তারপরও আমার মনে হয় সকল প্রকাশনী ঘুরেফিরে সকল বই স্টলে প্রদর্শন করে। বইমেলায় প্রকাশনী সমূহ স্টলই রাখছে বই প্রদর্শনের জন্য, পাঠকের হাতে তুলে দেবার জন্য। কারো বই স্টলে প্রদর্শন না করায় কোনো প্রকাশনীর লাভ আছে বলে জানা নাই। আমরা সব লেখককে সমান গুরুত্ব দিয়ে এসেছি সবসময়।

মিহিন্দা : রয়্যালটি নিয়েও অভিযোগ থাকে নতুন লেখকদের। আসলে নতুনদের বই পাঠক সেভাবে গ্রহণ করছে না? নাকি প্রকাশকদের বিপণনের ক্ষেত্রে অনীহা রয়েছে?
চৌ. ফা :  এই ব্যাপারটা আপেক্ষিক। লেখকের সাথে প্রকাশনীর চুক্তিটা ক্যামন সেটা কেবল তারাই ভালো জানেন। যদি চন্দ্রবিন্দুর কথা বলেন, আমরা এডভান্স রয়ালিটি দিয়ে অনেকগুলো পাণ্ডুলিপি নিয়েছি লেখকের কাছ থেকে। সময়মত লেখকের প্রাপ্য রয়ালিটি বুঝিয়ে দিতে চন্দ্রবিন্দু বদ্ধপরিকর।

মিহিন্দা :  প্রকাশক পাড়ায় 'মুরগী লেখক' নামে একটা শব্দ প্রচলিত। শব্দটা যথেষ্ট অপমানজনক ও বিব্রতকর। এটা নিয়ে কিছু বলুন।
চৌ. ফা :  সচেতনতা জরুরী। লেখক, প্রকাশনী উভয়ের সচেতনা খুব জরুরী। সময়ের আগে যেমন কোনো লেখকের প্রকাশিত হয়ে যাওয়া অর্বাচিন আচরণ, তেমনই লেখনীকে প্রকাশিত হবার মতো জায়গায় দাঁড় করানোর আগেই কোনো প্রকাশনীরই উচিত নয় কাউকে প্রকাশ করে দেয়া।

মিহিন্দা : কোন কোন প্রকাশকের থেকে এমন কথা শোনা যায় - বইমেলার যাবতীয় খরচের পর লগ্নিকৃত টাকাই উঠে আসছে না। বাস্তবতা আসলে কী?
চৌ. ফা :  ক্ষেত্রবিশেষে ব্যাপারটা হয়তো সত্য। জনসংখ্যার অনুপাতে পাঠক বাড়ছে না হয়তো। অথচ প্রতিবছর বইমেলায় প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা আগের মেলাকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। গত ১০/২০ বছরে যে পরিমান জনসংখ্যা বেড়েছে তাঁর অনুপাতে পাঠকের সংখ্যা বেড়েছে কি? না বাড়লে কেনো বাড়ছে না সেটা বিবেচনা করার সময় এসেছে এখন।

মিহিন্দা : লগ্নিকৃত টাকাই যদি উঠে না আসে, সেক্ষেত্রে প্রকাশক কেনো এই ব্যবসায় থাকবেন? যেহেতু শিল্পের সাথে এতে রুটিরুজির ব্যাপারও জড়িত?
চৌ. ফা :  থাকছে না তো! খোঁজ নিলেই দেখতে পাবেন অনেক প্রকাশনী বন্ধ হয়ে গেছে।

মিহিন্দা : পাঠকরা সেভাবে বই কিনছেন না। ভালো বই আসছে, কিন্তু সংখ্যাটা সেভাবে না। পাঠক-লেখক-প্রকাশক এই সমন্বয় এ কি কিছুটা ঘাটতি দেখা যাচ্ছে সাম্প্রতিক দশকগুলোতে?
চৌ. ফা :  আত্মকেন্দ্রিকতাই কারণ মনে করছি। হয়তো জীবন বা যাপনের চাপে দিনদিন মানুষ আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে। আগেই বলেছি জনসংখ্যা বেড়েছে, লেখক বেড়েছে, কিন্তু সংখ্যার অনুপাতে যে পরিমান পাঠক বাড়ার কথা তা হয়েছে কি! আর যারা আছেন তারাও নিজ গণ্ডির বাইরে খুব বেশি পা ফেলছেন না।

মিহিন্দা :  চন্দ্রবিন্দুর বিরুদ্ধে প্রায়ই যে অভিযোগটা পাওয়া যায়, চন্দ্রবিন্দু নির্দিষ্ট বলয়ের বাইরে বই প্রকাশ করে না..
চৌ. ফা : এই নির্দিষ্ট বলয় বলতে আসলে কি বুঝায়? চন্দ্রবিন্দু প্রথম বছর প্রায় ৫০ টি বই করেছে। যার অনেকগুলো পাণ্ডুলিপিই লেখকের কাছে অনেকবার চেয়ে চেয়ে কনভিন্স করে নিতে হয়েছে। এবার প্রায় ৫৫ টি বই হচ্ছে। যার অর্ধেকেরও বেশি বই লেখকদের সাথে বারবার মিটিং করেই নিশ্চিত করতে হয়েছে। অনেকেই চন্দ্রবিন্দুকে তাদের পাণ্ডুলিপি দেন নাই বা নানাবিধ কারণে দিতে পারেন নাই। যদি নির্দিষ্ট বলয়ের বই করতো চন্দ্রবিন্দু তাহলে নিশ্চয় লেখকের কাছে সেভাবে ধর্না দিতে হতো না? চন্দ্রবিন্দু প্রকাশিত বইগুলোর দিকে নজর দিলেই স্পষ্ট দেখতে পাবেন চন্দ্রবিন্দু কোনো গোত্রভুক্ত চিত্র নয়। চন্দ্রবিন্দু সার্বজনিন...

মিহিন্দা :  অতীত অভিজ্ঞতা থেকে, চন্দ্রবিন্দুর কোন বইগুলো পাঠক চাহিদার শীর্ষে থাকবে বলে আশাবাদী?
চৌ. ফা : চন্দ্রবিন্দু থেকে যে সকল বই আসছে প্রায় সবগুলো বইয়ের কন্টেন্ট নিয়ে চন্দ্রবিন্দু ও লেখক বারবার করে দ্বিপাক্ষিক আলাপ হয়েছে। আমরা স্পষ্ট করে বলতে পারি চন্দ্রবিন্দু প্রকাশিত বই সমূহের কন্টেন্ট উঁচু মানের এবং পাঠক সেটা খুঁজে নেবেন।

মিহিন্দা :  একটু আপনার বইয়ের কথায় আসতে চাই। এই বইমেলায় আপনার কী বই আসছে?
চৌ. ফা : গতবারের মতন এবারও একটি কবিতার বই আসছে 'ত্রৈ'। যাকে আমি বলছি কবিতার ওয়ালেট। বলতে পারেন এটা আমার একটা ফিলসফিকাল জার্নি। অল্প শব্দে ব্যাপার কথা বলার চেষ্টা ছিল এখানে। কবিতাগুলো মূলত গত ১০ বছরের নানা সময়ে লেখা।

মিহিন্দা : গতবইমেলায় 'দ্বি' এর পর এবার ত্রৈ আসছে? দ্বি থেকে কেমন সাড়া পেয়েছিলেন?

চৌ. ফা : 'দ্বি' আশাতীত সাড়া পেয়েছিল, যা আমার প্রত্যাশার বাইরের। এবং দ্বি নিয়ে পাঠকের প্রতিক্রিয়াও ছিল অনেক বেশি।

মিহিন্দা :  পাঠকরা 'ত্রৈ' কেনো কিনবেন?
চৌ. ফা :  পাঠকের না বলতে পারা কথাগুলোই বলেছে ত্রৈ। ত্রৈ পাঠ করলে পাঠকের মনের কোন থেকে বের হয়ে আসছে 'আরেহ! এটা তো আমার কথা'! এইজন্যই পাঠক ত্রৈ কিনবেন।

মিহিন্দা : ধন্যবাদ আপনাকে।
চৌ. ফা :  আপনাকেও ধন্যবাদ। শুভ বইমেলা, বইয়ের মেলা।

Post a Comment