কবি ও সম্পাদক মঈন ফারুক এর সাক্ষাৎকার
[ইমেইলে আমরা কবিকে একগুচ্ছ প্রশ্ন পাঠিয়েছিলাম। কবির পাঠানো উত্তরেই এ সাক্ষাৎকার যেখানে উঠে এসেছে কবির কবিতা ভাবনা,লিটলম্যাগ আন্দোলন, পরবাস্তবতা,উত্তরাধুনিকবাদসহ আরো অনেক বিষয়। ]
মিহিন্দা: মঈন ভাই,কেমন আছেন?
মঈন ফারুক: ভালো।
মিহিন্দা: আপনার কবিতার কথা দিয়েই শুরু করি। শুরুটা কেমন ছিলো?
ম.ফা: কবিতা দিয়েই শুরু এটা মনে আছে। কেমন, কেন, কিভাবে ছিল সেটা মনে নেই। কোথায় হেঁটেছিলাম, কী ভেবেছিলাম, কী পড়েছিলাম— যা থেকে লেখা শুরু করেছিলাম, সেসবের কিছু মনে নেই। শৈশব থেকে একরকম বৈরীতা অনুভব করেছি, সেসব মনে করার চেষ্টা করি, মনে করতে পারি না। ছোটবেলায় একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলাম, ওই সময়ের বয়সটা মনে নেই। বালক বয়স থেকে মানুষের স্মৃতি কাজ করা শুরু করে। আপনি চাইলে স্মৃতিচারণের মধ্য দিয়ে বালক বয়সের স্মৃতি খুঁজে পাবেন কিছু না কিছু, শিশুকালের পাবেন না। মতিষ্ক স্বপ্রণোদিত ভাবে কাজ করে এ সময়। তো, প্রত্যেক মানুষই একটি অর্পিত জন্ম লাভ করে। কোথায়, কখন, কিভাবে জন্মাবে সে জানে না। জন্মের পর সে মেনে নিতে বাধ্য হয়। মৃত্যুও ভাবাতো। ভাবতাম মৃত্যুকেও মেনে নিতে হবে। এইসব ভাবনাগুলো যে বোধ থেকে আসতো, সেটাকে ধরতে চাইতাম। উদাসিন থাকতাম। খুব কল্পনাপ্রবণ ছিলাম। আমার জবুথবু হয়ে থাকা জীবনের সেই আজেবাজে সময়ই আমাকে ধীরে ধীরে টেনে এনেছে এখানে।
মিহিন্দা: প্রথম দুইটা বই প্রকাশের পর একটা দীর্ঘ বিরতি। প্রায় ৬ বছর। অনেক সময়। এতো লম্বা বিরতি কেনো?
ম. ফা: আমার জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল এটা। প্রেমে ডুবে ছিলাম। প্রেমিকা থাকত আবুধাবিতে। নাম লুৎফা আক্তার। প্রেমিকার টানে আবুধাবি চলে গিয়েছিলাম। যা ভেবে গিয়েছিলাম, যে ঘোর কাজ করেছিল, সেখানে পৌঁছার পর আমার সে ঘোর কেটে গেল। দেখা হয়েছিল, কথাও হয়েছিল, কিন্তু সম্পর্ক আর ফিরেনি। নানা বাস্তবতায় আমাকে যদিও থেকে যেতে হয়েছিল। ৬ বছর ছিলাম। সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন। ওই সময় একেবারেই যে লিখিনি তাও না। যা লেখা হয়েছে তা ‘অশ্রু গোলাপজলের মতোই সুঘ্রাণ’ এ আছে। ছয়সাতটা হবে হয়ত। ছয় বছরে এ ছয়সাতটা!
মিহিন্দা: কবিতার বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে কবি মঈন ফারুক অনন্য। আপনি কি মনে করেন এটা স্বতঃস্ফূর্ত? নাকি সাধনা?
ম.ফা: হ্যাঁ। স্বতঃস্ফূর্ত। মূর্ত হতে হলে বিষয়বস্তু স্বতঃস্ফূর্ত হতে হয়। সাধনার ব্যাপারটা থাকে ভাষায়। একটা কথা বলতে পারি— মাংস যখন পোড়ানো হয়, তখন তা কত সংযত ভাবে পোড়ানো সম্ভব, সে চেষ্টা করা হয়— যেন বিশেষভাবে পোড়ে এবং খাওয়ার উপযোগী থাকে। যাপনের যে অধ্যায়গুলো থেকে মুখের হাসি ও চোখের জল গ্রহণ করেছি, সে তাগিদও ছিল তীব্রতর, স্বতঃস্ফূর্ত সেটা আমাকে অর্জন করতে হয়নি। তবে ভাষা আমাকে আয়ত্ব করতে হয়েছে।
মিহিন্দা: কবিতার বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে পরবাস্তববাদকে কীভাবে দেখেন?
ম.ফা: যেকোনো চিন্তা কোনো না কোনো এক পরিস্থিতিকে ঘিরে লোকায়ত হয়। একই চিন্তা সব পরিস্থিতিতে যথার্থ হওয়া আবশ্যক নয়। পরাবাস্তববাদের উৎপত্তিসময়কে আমরা এখনো ওই একভাবে ধরে আছি। এটার কারণও আছে। পরাবাস্তববাদে যেসব অতিন্দ্রিয়জাত বোধ আলোড়ন তৈরি করেছিল, সেগুলো আমাদের ভেতর নির্বিচারে মন্ত্রের মত ক্রিয়াশীল। বিচারবোধে আমরা উত্তীর্ণ হতে পারছি না। পরাবাস্তববাদের মূলকথা হচ্ছে ‘অবচেতন মনের ক্রিয়াকলাপকে উদ্ভট ও আশ্চর্যকর সব রূপকল্প দ্বারা প্রকাশ করা’। বাহ্যিকভাবে কবিতা এরকমই একটি রূপ ধারণ করে। কিন্তু ‘প্রকৃত সত্য কেবলমাত্র অবচেতনেই বিরাজ করে’ না। (উর্ধ্বকমাযুক্ত অংশ পরাবাস্তববাদীদের।) দৃষ্টান্তের স্বরূপও উপলব্ধিতে রাখতে হবে। সাহিত্য চৈতন্যেরই চারু উচ্চারণ। তবে যাপিত জীবনের বিধৃত অংশকে এককভাবে উদ্ভট ও ভৌতিকভাবে তুলে ধরতে চাইলে তা জীবনের জন্য বেদরকারী হয়ে উঠবে।
মিহিন্দা: আপনার কবিতায় কোথাও যেনো এই সমাজের প্রতি একটা ক্ষোভ,অভিমান লুকিয়ে আছে..
ম.ফা: শুধু সমাজ নয়, পুরো বাস্তবতার প্রতি। এটা অভিমান না, ক্ষোভ। চাপা না, সশব্দে। সে শব্দের বাগাড়ম্বর শুধু লেখায় থাকে। আমার যা কথা, তার সবই লেখার ভেতর দিয়ে উষ্ণশ্বাস ছড়ায়। মুখে ব্যক্তি আমার কোনো রা নেই। আমি হাঁটি নিঃশব্দে, থাকি একা।
মিহিন্দা: উপন্যাসকে আপনি দ্বিতীয় অবলম্বন মনে করেন। আপনার উপন্যাস এবং উপন্যাস সম্পর্কে আপনি কী মনে করেন জানতে চাই..
ম.ফা: ঋষিকে যেমন মান্য করে মানুষ, লেখককেও তেমনি মান্য করে। এখানে একটা পার্থক্য আছে। ঋষিকে ভয়ের কারণে মান্য করে অনেক সময়। কিন্তু লেখককে ভয়ে মান্য করেন না। লেখক সেইসব সত্যের কথা মানুষের মনপুত ভাবে তুলে আনেন যা মানুষ জানতে আগ্রহী, শুনতে আগ্রহী। এই যে মানুষের মনপুত কথাগুলো, এগুলো কবিতায় যতই বলেন, কবিতার বৈশিষ্টগত কারণে তা মানুষকে কাব্যিক ব্যঞ্জনায় আন্দোলিত করলেও মানুষের বোধের সরলগণ্ডিতে প্রবেশ করাতে পারেন না কবি, পারলেও তা নির্দিষ্ট কোনো শ্রেণীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। ফলে লেখক পৌঁছাতে পারেন না তার অমীয়বাণী, বিস্মিত ভাষণ। উপন্যাস এ ক্ষেত্রে অবারিত মাঠের মত। তার ভাষা ও নির্মাণশৈলী জৈবনিক বৈশিষ্টের সাথে সম্পর্কিত হওয়ার কারণে, যাপনের অনুসঙ্গে খোলা ও চিত্রময় থাকার কারণে উপন্যাস মানুষকে প্রলুব্ধ করে। যদিও দুটোর দুরকম আনন্দ, কিন্তু বোধগম্যতার বিচারে উপন্যাসই জীবনঘনিষ্ট।
মিহিন্দা: নতুন উপন্যাস কবে আসছে? এর ক্ষেত্রেও কি দীর্ঘ বিরতি হবার সম্ভাবনা আছে?
ম.ফা: কবে আসছে তা বলা মুশকিল। গত দেড়বছর ধরে কাজ করছি পরবর্তী উপন্যাসটি নিয়ে। এটার নাম ‘মধুবালা’। নিভৃতে নারী অধিকারের যে আন্দোলন বিস্তৃত হচ্ছে তার গতিপ্রকৃতি নিয়ে এ উপন্যাস। এটা কোন দিকে যাচ্ছে বা যেতে পারে, এরকম একটি চিন্তা আমার ভেতর কাজ করছে। নানাভাবে উপলব্ধি করার চেষ্টা করছি সেটার দূরবর্তী সময়কে। কিছু অংশ বর্তমান সময়ের চিত্র, কিছু অংশ ভবিষ্যতের কাল্পনিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে এগুচ্ছি। যাতে নতুন চিন্তার বিস্তার ঘটে। যেহেতু আমি উপন্যাস বড় করার পক্ষপাতি নই, সেকারণে সময়টা বেশি লাগছে। অর্থাৎ লিখতে গিয়ে যতটুকু অগ্রসর হয়েছি, তাতে বেশ বড় আকার ধারণ করছে, সেটাকে ছোট করতে গিয়ে সময় লেগে যাচ্ছে।
মিহিন্দা: বাংলা সাহিত্যের বর্তমান দশক একটা উথাল-পাতাল সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। সবাই যেন বিচ্ছিন্ন। যে যার মতো লিখছেন। আপনার কী মনে হয়?
ম.ফা: এটা হতে পারে অজ্ঞতা বা মস্তিষ্কের বিকৃতি। ধারণে অক্ষমতা বা নিয়ন্ত্রণে অক্ষমতা। সম্ভব সবকিছু তো মানুষ গুছিয়ে করে। যখন এলোমেলো হয় তখন বুঝতে হবে সে অসম্ভব নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। নিজের অসংলগ্নতাকে চাপা দেয়ার জন্য আমরা খুব হালকাভাবে বলে ফেলি, কবিতা বিমূর্ত— সূতরাং তাকে নিয়ে যেভাবে খুশি খেলা যাবে! সেটা যেভাবে খুশি খেলার ক্ষমতা তো সবার মাঝে নেই। যার কাছে নেই সে তো এলোমেলো করবেই। যাদের মাঝে সে সক্ষমতা আছে, দেখবেন, তাদের এলোমেলোটাও সাজানো-গোছানো, ব্যতিক্রম সুন্দর্যে বৈশিষ্টময়। কবিতার ভেতর বিচ্ছিন্নতার কথা বলছেন, ওটা থাকবেই। সবার তো হয়ে উঠে না। তাই বলে কি লিখবে না? লিখবে। যার হয়ে উঠার তার উঠবেই। কবিতা যে যার মতোই লিখতে হবে। তবে তা শেষপর্যন্ত কবিতার মত হলেই হয়। এটা সত্য যে, এ সময়ের কবিতা ভাষার বৈশিষ্ট্য এবং বোধের বিশেষত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন। দুটোই সাময়িকতার মধ্যে আটকে যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ অতিদূরদর্শীতা দেখাতে গিয়ে বিচ্ছিন্নই হয়ে পড়ছেন। কবিকে রেখে, ছেড়ে— মজাদার, ব্যঞ্জনাপূর্ণ চিত্রকল্প ও বাক্য সাজাতে হয়। সে কাজটি ক’জনেই-বা করতে যাচ্ছে— অতটা বোধের গভীরে প্রবেশ করে!
মিহিন্দা: উত্তরাধুনিক কবিতা সম্পর্কে আপনার কী মনে হয়? যে সকল কবিতাকে কালোত্তীর্ণ বলা হচ্ছে,তা আসলে কতটা কালোত্তীর্ণ?
ম.ফা: স্থান ও কালের উত্তেজনা কবিতায় ঘনিষ্ঠভাবে বিরাজ করে। সে উত্তেজনাকে সচেতনভাবে টানা কবিতার জন্য ক্ষতিকর মনে হয় আমার কাছে। তাতে কবিতার সতেস্ফূর্ততা নষ্ট হয়। মনে হয় কবিতা হচ্ছে না, হওয়াচ্ছি। উত্তরাধুনিক চেতনা একরকমই একটি ব্যাপার। যেহেতু তারা স্পষ্টভাবে আধুনিকতার প্রতিদ্বন্দ্বি। কবিতায় বিরোধীতা থাকেই, প্রতিবাদ থাকেই। তবে তা এক কলোনিয়ালকে টেক্কা দেয়ার জন্য আরেক কলোনিয়াল সৃষ্টি করে নয়। বাঁশঝাড়ের বাঁশ কি এই সীদ্ধান্ত নিয়েই লাগানো হয়ে যে, এটা শুধু সাঁকু তৈরির কাজেই লাগানো হবে! আর, এ সময়ের কালোত্তীর্ণ কবিতা, এটা কীভাবে বলা যায়! মুর্খতা ছাড়া! এই যে কালোত্তীর্ণ কবিতা বলেন, এটা খুবই অস্বাভাবিক চিন্তা। সবার ভেতর সম্ভ্রান্ত চিন্তা কবিতা লেখার আগেই কাজ করা শুরু করে, সবাই ধ্রুপদাঙ্গ হতে চায়, এটা কেন? এটা বরং কবিতাকে প্রভাবিত করে এবং কবিতার বিশেষত্ব ও স্বকীয়তা নষ্ট করে। সমকালীন কবিদের মাথা নষ্ট করছে এটা। জীবনানন্দের অদ্ভুতআঁধারএক তো পড়েছেন? অবশ্যই এ কবিতা তিনি কালজয়ী হবে তা চিন্তা করে লিখেননি। লিখলে এ কবিতা কালের অতলে হারিয়েই যেত। নানা দুর্বলতা চেপে ধরত কবিতাটাকে। কিন্তু এখন তা হয়নি। কারণ, তিনি কালোত্তীর্ণের চিন্তায় লিখেননি, লিখেছেন স্বতঃস্ফূর্ত চিন্তায়। আসল কথা হলো— কবিতা যে যাপন দাবী করে, কবিতাকে সে যাপন দিতে পারলে, কবিতা কবিকে মহৎ করে তোলে, মহৎ কবিই পারে কালোত্তীর্ণ কবিতা লিখতে। বাকীসব ঝারিঝুরি-দৌড়ঝাঁপ, বৃথা প্রচেষ্টা।
মিহিন্দা: বাংলা সাহিত্য কি আধুনিকবাদের পাঠ না শেষ করেই উত্তরাধুনিকবাদের দিকে যাত্রা শুরু করেছে? যদিও পশ্চিমে উত্তরাধুনিকবাদের সূচনা বহু আগে..
ম.ফা: এগুলো চর্বিতচর্বন। অনেকাংশে নেতৃত্বের লড়াইও। আধুনিকতাবাদ বা উত্তরাধুনিকতাবাদ নিয়ে খুব বেশি মাথাঘামানোর কারণ দেখি না। কবিকে সমকাল থেকে অনাগতকালের দিকেই মনোনিবেশ করা বেশি জরুরী। পাঠ-অপাঠ এগুলো কবির জন্য অযথার্থ আলাপ। পাঠে কবির পাণ্ডিত্য আমি নির্বিচারে মানি না। ধ্যান ও দেখার চোখ চাই কবির। উপলব্ধির বোধ চাই। এমনিতেই এগুলো কেবল কেন্দ্রই তৈরি করছে, কবির সাথে এসবের কোনো সখ্যতা থাকতে পারে না। কবি বরং কেন্দ্র ভাঙ্গেন এবং নির্মাণ করে দেন ভাঙ্গার হাতিয়ার। গড়েন সুন্দর্য, ছড়িয়ে দেন সর্বময়। আর, কবি বর্তমানে ঘাই তুলে ভবিষ্যতে ভেসে বেড়ান।
মিহিন্দা: টানা গদ্যের কবিতাকে কীভাবে দেখেন?
ম.ফা: অন্তত কবিতা হিশেবে দেখি না। দেখার সুযোগ নেই। গদ্য হিশেবেই দেখি। ওটা পড়ার মজা আছে। গদ্য হিশেবে পড়ে মজা পাই। তবে এগুলো টানা চিত্রধারণ করলে আরও মজাদার হবে গদ্যরচনা হিশেবে। ভেতরে গল্পময় কারুকাজ থাকলে, চিত্রময় স্বচ্ছতা থাকলে গদ্যের নতুন একটি ধারা হিশেবে দাঁড়াবে। তবে, কবিতা হিশেবে দাঁড় করানোর প্রচেষ্টায় গল্প টানার মাঝে ছেদ টানার প্রবণতায় এগুলো দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে আছে, না কবিতা না গদ্য হিশেবে। উপরিশব্দের ব্যবহারে বেশিরভাগই বাহুল্যতায় ভরপুর। এই ক্ষেত্রে এগুলোর কবিতার সম্ভাব্যতা নাকচ করলেও মৌলিক গদ্যের নতুন ধারা হিশেবে সমীহ করি।
মিহিন্দা: আপনি লিটলম্যাগ আন্দোলনের সাথে জড়িত। চন্দ্রবিন্দু নামে একটা লিটলম্যাগ সম্পাদনাও করেছেন। এ সময়ে এসে লিটলম্যাগ আন্দোলন কতটা সফল মনে করেন?
ম.ফা: প্রথমত, আমি এইরকম কোনো আন্দোলনে নেই, কোনোরকম আন্দোলনেই আমি জড়াই না। ওইটাকে কোনোভাবেই আমার কাজ মনে করি না। কারণ, লিটলম্যাগ আন্দোলন যারা করেন, তারা আবার প্রতিষ্ঠান বিরোধী, আমি প্রতিষ্ঠান বিরোধী না। হ্যাঁ, লিটলম্যাগ সম্পাদনা করি। দীর্ঘদিন ধরে করে আসছি, এখনো করছি। যে চিন্তা নিয়ে শুরু করেছিলাম, এখনো সে চিন্তাই করি। লিটলম্যাগের কোনো সফলতা নেই। চিন্তার দূরত্ব ব্যাপক এখানে। এই সিকি-সিকি কাজ দিয়ে সফলতা নিরুপণ করা যায় না। চিন্তার দূরত্ব না ঘুচলে উত্তরণ সম্ভবও নয়। এখন, দূরত্ব ঘুচানোর চটজলদি কোনো পথ নেই। এটা ধীরে ধীরে হয়ত হবে। আশারাখি।
মিহিন্দা: চন্দ্রবিন্দুর বিরুদ্ধে গ্রুপিং এর একটা অভিযোগ আছে...
ম.ফা: অভিযোগটা যখন গ্রুপ নিয়ে, তাহলে এটাও বলতে হবে— গ্রুপটা কাকে নিয়ে? একা একা তো গ্রুপ হওয়া যায় না। লিটলম্যাগের সম্পূর্ণ কাজ আমি নিজেই করি। লেখকদের সংশ্লিষ্টতা থাকে, তাও সুনির্দিষ্ট কেউ নন। নতুনদের পাশাপাশি অগ্রজদের লেখাও ছাপা হয়। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেই নিভৃত জীবন যাপন করি। ফলে, কারও সাথে আমার অতিসখ্যতা গড়ে ওঠা কঠিনও! ছাপা হওয়া লেখকদের বেশিরভাগই আমার অচেনা। মেইলে লেখা আসে, এগুলো আমি পড়ি এবং বাছাই করি। সূতরাং, যারা এ দলবদ্ধতার অভিযোগ করছেন, তারা মূলত দূর থেকে দূরেই ঢিল ছুড়ছেন, কাছ থেকে দেখার চেষ্টা হয়ত করছেন না। আর, আপনি জানেন, চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন— এটা আমাদের দুজনের যৌথ প্রতিষ্ঠান। আমি এবং কবি চৌধুরী ফাহাদ। সেইসাথে লেখক এবং পাঠকরাও শুভাকাংখি হয়ে আমাদের পাশে থাকেন। চন্দ্রবিন্দু লিটলম্যাগ ও প্রকাশন সবার জন্য উম্মুক্ত প্ল্যাটফর্ম। সমান্তরাল চিন্তায় সবাইকে কাছে টানতে আমরা সাধ্য অনুযায়ী চেষ্টা করি।
মিহিন্দা: আপনি একজন প্রকাশকও। বর্তমান সময়ে প্রকাশনা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে বলা যায়। পাঠক বই থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। প্রচুর মানহীন বই আসছে। ভালো বইয়ের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এমন হচ্ছে কেন? আপনি কী মনে করেন?
ম.ফা: মানহীন বই সবসময়েই ছিল। তবে এ সময়টাতে ব্যাপারটা বেশি ঘটছে। মানহীন বই আসছে, এটা ঠিক, তবে ভালো বইয়ের সংখ্যা যে কম তা ঠিক না। পাঠকের সংখ্যাও কমেনি। বরং তুলনামূলক হিসাব করলে দেখা যাবে পাঠকের সংখ্যা বেড়েছে। বেড়েছে লেখকের সংখ্যাও। এ বেড়ে যাওয়া লেখকই বিপত্তির কারণ। একটা বাজে বই যখন প্রকৃত পাঠকের হাতে যাবে, সে বিব্রত হবে এবং সে আরও পাঠককে তাতে অন্তর্ভুক্ত করবে, বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে। তবে, পাঠক-লেখকের চেয়ে প্রকাশনীর পরিমান আশঙ্ক্ষাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং প্রকাশনীর উপর প্রকাশ ও বিপণন বিষয়ে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। অনলাইনভিত্তিক গ্রুপগুলো এ পরিস্থিতির জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। হালের বেশকিছু এরকম প্রতিষ্ঠান আঙ্গুলফুলে কলাগাছের মত অবস্থায় দেখা যাচ্ছে। এগুলো নিয়ন্ত্রণ বোধহয় সম্ভবও নয়!
মিহিন্দা: এখনকার তরুণ কবিদের মধ্যে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে প্রবীণদের মধ্যেও বইয়ের ইংরেজি অথবা বাংলা ইংলিশ সংমিশ্রণে নামকরণ করার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এটাকে কীভাবে দেখেন?
ম.ফা: আমার মনে হয়, তারা বর্তমান এ প্রজন্মের জন্যই কবিতা লিখছেন। এ সময় এটাই তো চলছে। মানুষ কথা বলার সময় বাংলা যত শব্দ ব্যবহার করে তার চেয়ে বেশি শব্দ ব্যবহার করে ইংরেজি। সময়ের সাথে তাল দিয়ে চলার চেষ্টা হতে পারে। বাজার ধরার প্রচেষ্টাও হতে পারে। না হলে এমন কেন হবে? দেখুন, বাংলা ভাষায় অন্যভাষার কম শব্দ নেই। সেগুলোর পাঠকৃতি আধুনিক এবং ভাষারীতির সাথে সামাঞ্জস্যপূর্ণ। বিশেষ অর্থবোধক শব্দের ক্ষেত্রে অন্যভাষার শব্দ গ্রহণ করা হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু দেখেন, এখানে হরেদরে বসিয়ে দেয়া হচ্ছে অন্যভাষার কথ্য শব্দ ও বাক্য। এগুলো ভাষা বা সাহিত্যে বিশেষ কোনো বিপত্তি তৈরি করবে বলে মনে হয় না। এটা যারা করছেন তাদেরই দৈন্যতা। দৈন্যতা একারণেই যে, তারা চাইলে আরো নান্দনিক কোনো সমার্থক শব্দ সেখানে ব্যবহার করতে পারতেন, যার ব্যঞ্জনা আরও মাধুর্যপূর্ণ হয়ে উঠত। সর্বোপরি, এটা বিকৃতিই। বিকৃতি কোনো কালে খুব বেশি সময় টিকেনি। আর যদি টিকেও যায়, তাহলে তাকে আমি বলব অধঃপতন।
মিহিন্দা: সাহিত্যের ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়া,অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোকে কীভাবে দেখেন?
ম.ফা: সাহিত্য করার জন্য কোনো প্ল্যাটফর্মেরই প্রয়োজন নেই। লেখালেখি দলবেঁধে করার কাজ না। এটা একাই করতে হয়। পরন্তু স্যোশাল মিডিয়া লেখালেখিকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে। তবে বিপণনে সুবিধা তৈরি করেছে স্যোশাল মিডিয়া। অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো বিপণন ও প্রচারণার কাজ করছে। লিটলম্যাগের মত ওয়েভম্যাগ নিয়েও কাজ করছে কেউ কেউ। লেখা ও লেখক প্রযুক্তির সহায়তায় খুব সহজে পৌঁছে যাচ্ছে পাঠকের কাছে। এখানে একটা বিপত্তিও লক্ষ্য করা যাচ্ছে, সেটা হলো, যেকেউ খুলে ফেলছে সাইট আর এইসব সাইট দিয়ে জন্ম হচ্ছে নানা গ্রুপের। যেগুলো অরুচিকর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ব্যস্ত।
মিহিন্দা: এ সময়ে লিখছেন তরুণদের মধ্যে কার লেখা ভালো লাগে?
ম.ফা: তরুণ বলতে এ সময়ের যারা নতুন মুখ তাদের ব্যাপারে বলতে পারি। এদের বেশিরভাগকেই দেখি জবরদস্তিমূলক কবিতা লিখতে। কারও কারও কবিতা মনে হয় যেন— হয়েও হয় না। তার ভেতরেও অনেকের কবিতা ভালো লাগে। নাম বললে অনেকের নাম বলতে হয়। যদিও আমার স্মৃতিশক্তিও দুর্বল। অনেকের নাম মনেও আসবে না।
মিহিন্দা: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
ম.ফা: ধন্যবাদ।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন