[শিকদার ওয়ালিউজ্জামান। জন্ম- ১৭ জানুয়ারি ১৯৭৬।জন্মগ্রাম- ভিটাসাইর, মাগুরা।সম্পাদনার ছোটকাগজ- সপ্তক ও জলসিঁড়ি। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ- 'ধূসর অরণ্যের আকাশ'(২০১১) প্রকাশক-বিভাস । 'মধ্যবর্তী আলো ও কুয়াশা' (২০১৬) প্রকাশক পুঁথিনিলয়। 'ব্যর্থতার রাজহাঁস এবার থামো' (২০২০) প্রকাশক- অনুভব। সম্পাদনাগ্রন্থ-প্রথম দশকের কবি ও কবিতা বিষয়ক সংকলন 'দশকপ্রথম' (২০১২)। প্রকাশক- কবি। কথা বলেছেন, যাপিত জীবন এবং সাহিত্যের নানা দিক নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন - রাফাতুল আরাফাত। ]
রাফাতুল আরাফাত: ভাই কেমন আছেন?
শিকদার ওয়ালিউজ্জামান: পূর্ব পুরুষ শিখিয়েছেন, হাজার মন্দ থাকলেও বলতে হয় ভালো আছি। সেই সূত্রে ভালো আছি। পৃথিবী ঘুমিয়ে আছে। আসলে পৃথিবী কি ঘুমায়? নিয়মিত শব্দের চাষ করছি। কখোন রোদহীন মাঠ, কখনো রোদের ঝিলিক। এই তো জীবন।
রাফাতুল আরাফাত: আপনি ছোটো কাগজ সপ্তক ও জলসিড়ির সম্পাদনা করছেন। সপ্তকের শুরুটা জানতে চাই।
শিকদার ওয়ালিউজ্জামান: আমি ‘সপ্তক’ সম্পাদনা করি। জলসিঁড়ি প্রথম তিনটি সংখ্যার সম্পাদনা করেছি। পরবর্তী সংখ্যাগুলোর সম্পাদক এম মনির উজ জামান। তবে জলসিঁড়ি সম্পাদনার ক্ষেত্রে সপ্তক সাহিত্যচক্র’র সকল সদস্যের সমষ্টিগত শ্রম ও আর্থিক অবদান থাকে। মূলত ‘সপ্তক’ প্রকাশনার পর ‘জলসিঁড়ি’ দ্বিতীয় প্রয়াস। তবে দুটো কাগজই সপ্তক পরিবারের প্রেম আর শ্রমের ফসল। সপ্তক এর প্রথম প্রকাশ ২০১১ সালে। তারপর আরো পাঁচটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। ‘সপ্তক’ ও ‘জলসিঁড়ি’ দুটো কাগজেরই একটি সম্পাদনা পরিষদ থাকে। লেখা সংগ্রহ ও যাচাই-বাছাইয়ে তাদের বেশ ভূমিকা থাকে। তবে দু’টি কাগজই কবি নির্ঝর নৈঃশব্দ্য, কবি রিঙকু অনিমিখ, কবি বিধান সাহা, কথাসাহিত্যিক মোজাফ্ফর হোসেন, কবি অরবিন্দ চক্রবর্তীসহ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আরো অনেকের কাছে ঋণী। আমাদের সকলের সমষ্টিগত প্রচেষ্টাতে সপ্তকের আজকের অবস্থান।
রাফাতুল আরাফাত: এতোগুলো বছর পেরিয়েও সপ্তকের পুরোপুরি লিটল ম্যাগ না হয়ে উঠতে পারাটাকে কীভাবে দেখেন?
শিকদার ওয়ালিউজ্জামান: সপ্তকের যাত্রা শুরু হয়েছে ১০ বছর। অনেকগুলো বছরই বলতে পারো। সপ্তক পুরোপুরি লিটল ম্যাগ হয়ে উঠতে পারেনি মানছি। কিন্তু বিগত ১০ বছরে এর অবদান কোনভাবেই অস্বীকার করতে পারবে না। ধরো, তুমি যেখানে বড় হয়ে উঠছো সেখানকার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ তোমাকে প্রভাবিত করবেই। সপ্তকের যাত্রা শুরুর আগে মাগুরা জেলায় লিটল ম্যাগ কনসেপ্ট গড়ে ওঠেনি। অগ্রজরা সাহিত্য চর্চা করেছেন। অনেক ত্যাগও আছে তাদের বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকা তৈরি করার। কিন্তু সেগুলোর সাহিত্যমান তেমন ছিলই না। লিটল ম্যাগ কনসেপ্ট তো দূরের কথা। সে রকম অন্ধকার এক আবহ থেকে সপ্তকের জন্ম। আমি এর আগেও কাগজ করেছি। তা ঐ অগ্রজদেরকে অনুসরণ করেই। সপ্তক জন্মের পর তাকে ঘিরে একটি পরিবার কিন্তু গড়ে উঠেছে। মাগুরায় এবং মাগুরার বাইরেও। আমরা কিন্তু উত্তরোত্তর আমাদের সকল সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি করি এবং তা উত্তরণের চেষ্টাও করি। অনেক তরুণকে তুলে এনেছে সপ্তক। প্রাতিষ্ঠানিকতার বৃত্ত থেকে আমরা বেরনোর চেষ্টা করি। আমরা কোন সিন্ডিকেট গড়ে তুলি না। নেতিবাচক গোষ্ঠিচর্চাও করি না। আমরা সম্ভাবনাকে বিকশিত করার চেষ্টায় থাকি। সপ্তকের পাশাপাশি জলসিঁড়ি প্রকাশ হচ্ছে। আমরা চেয়েছিলাম, যতটুকু সপ্তক পারবে পরবর্তী প্রজন্ম এসে তাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আমি মনে করি, সপ্তক সঠিক ট্রাকেই আছে।
রাফাতুল আরাফাত: লিটলম্যাগ আন্দোলনকে কীভাবে দেখেন? আপনার কি মনে হয় লিটলম্যাগ আন্দোলন সফলতার মুখ দেখছে/ দেখবে?
শিকদার ওয়ালিউজ্জামান: ছোটকাগজের এখন সংকটকাল। যদিও এমন সংকট সবকালেই ছিল। তবে তা অন্যরকম। বর্তমান সময়ে রাজধানীকেন্দ্রিক অধিকাংশ ছোটকাগজ এবং রাজধানীর বাইরের কিছু কাগজ অতিমাত্রায় বিজ্ঞাপননির্ভর হয়ে পড়ছে। তাদের আকার আর কোনভাবেই ছোট থাকছে না। ছোটকাগজের সাইজ বড় হওয়ার পাশাপাশি কাট-পেস্ট চর্চার মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে, শুধু লেখক নয়, সম্পাদকের ক্ষেত্রেও। গোষ্ঠীভিত্তিক সুনির্দিষ্ট আদর্শও থাকছেনা বেশিরভাগ কাগজেই। ফলে ছোটকাগজের জন্য শুধু সংকটই তৈরি হচ্ছে। নতুন প্রজন্মের সম্পাদকগণ কেবল ভুল পূর্বসূরী পাচ্ছে। তারা অগ্রজদের সেখানো ভুল পথেই হাঁটছে। ক্লাসিক চর্চা ফিকে হয়ে যাচ্ছে।
এখন অনেকে গোষ্ঠি নির্মাণ না করেও একাই সম্পাদনা করছেন ছোটকাগজ। সুতরাং গোষ্ঠিভিত্তিক সুনির্দিষ্ট আদর্শ থাকছে না। একটাই ছোটকাগজ, একজনই সম্পাদক, একই প্রতিষ্ঠান। লিটল ম্যাগাজিনের যে প্রবণতা তা কিন্তু থাকছে না সেখানে। ফলে ছোটকাগজের জন্য শুধু সংকটই তৈরি হচ্ছে।
রাফাতুল আরাফাত: যে কোনো আন্দোলনের ক্ষেত্রে সফলতার একটা বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করে মধ্যবিত্ত শ্রেনীকে সম্পৃক্ত করা। লিটলম্যাগগুলো কি মধ্যবিত্ত শ্রেনীকে সম্পৃক্ত করতে পারছে? সাহিত্য কি ধীরে ধীরে মধ্যবিত্ত শ্রেনী থেকে দূরে সরে যাচ্ছে?
শিকদার ওয়ালিউজ্জামান: লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক মধ্যবিত্ত শ্রেণীভুক্ত হওয়ার কারণে তাকে তার নীচের দিকে তাকাতে হয়, তেমনই উচ্চবিত্তের পুঁজিবাদি বিলাশকেও আমলে নিতে হয়। উচ্চবিত্ত কর্ত্তৃক নিম্নবিত্ত লাঞ্ছিত ও বঞ্চিত হওয়ার ঘটনায় তিনি মানবিকতার প্রতিফলন ঘটাবেন তার কাগজটিতে। উচ্চারণ করবেন জোর প্রতিবাদ। এটাই লিটলম্যাগ আন্দোলন। এই আন্দোলনে সম্পাদক যত বেশি মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে সম্পৃক্ত করতে পারবেন ততটাই তার সফলতা। নতুনস্বর ও সাহসী উচ্চারণের জন্য সম্পাদককে প্রস্তুত থাকতে হয়। তাকেই ভাঙতে হবে প্রাতিষ্ঠানিকতার চলমান ধারা। এই ভাঙা-গড়ার খেলায় কোনকালে উচ্চবিত্তরা এগিয়ে আসেনি। নিম্নবিত্তদের ক্ষেত্রেতো নয়ই। পৃথিবীতে যত ধরনের আন্দোলন হয়েছে, তা করেছে মধ্যবিত্তরাই। উচ্চবিত্তের শাসন আর শোষণের বিরুদ্ধে, শাসিত আর শোষিতের পক্ষে যারা মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের।
রাফাতুল আরাফাত: দীর্ঘদিনের স্থিতিশীলতা সাহিত্যের চারপাশে এক ধরনের উচ্চবিত্তীয় দেয়াল তৈরী করে। এটাও কি একটা কারণ মধ্যবিত্ত ধীরে ধীরে কবিতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার?
শিকদার ওয়ালিউজ্জামান: ছোটকাগজ সম্পাদকের জন্য সিদ্ধান্ত একটা বড় ফ্যাক্ট। তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তিনি কোন্ ধরণের গোষ্ঠীচর্চা করবেন। এখন অনেকে গোষ্ঠি নির্মাণ না করেও একাই সম্পাদনা করছেন ছোটকাগজ। সুতরাং গোষ্ঠিভিত্তিক সুনির্দিষ্ট আদর্শ থাকছে না। একটাই ছোটকাগজ, একজনই সম্পাদক, একই প্রতিষ্ঠান। লিটল ম্যাগাজিনের যে প্রবণতা তা কিন্তু থাকছে না সেখানে। ফলে ছোটকাগজের জন্য শুধু সংকটই তৈরি হচ্ছে। এই সংকট থেকে তৈরি হচ্ছে সাহিত্যচর্চার স্থবিরতা। এই সীমাবদ্ধতার কারণেই সাহিত্যকে ঘিরে ধরছে উচ্চবিত্তীয় দেওয়াল। মধ্যবিত্তদের কিছুই করার থাকছে না। পুঁজিবাদের যাতাকলে পিষ্ট হয়ে মধ্যবিত্তরা খেই হারিয়ে ফেলছে। ক্ষুধা বাড়ছে। জীবন-জীবিকার জটিলতা সাহিত্য চর্চা থেকে মধ্যবিত্তদেরকে বিচ্ছিন্ন করছে ক্রমশ।
রাফাতুল আরাফাত: লিটলম্যাগগুলোকে কেন্দ্র করে গ্রুপিং, পলিটিক্স, সিন্ডিকেটের সৃষ্টি হয়েছে৷ এগুলো দেখে কষ্ট লাগে না?
শিকদার ওয়ালিউজ্জামান: লিটল ম্যাগ একটি আদর্শের জায়গা। প্রজ্ঞা, সমর্পন ও ত্যাগের জায়গা। একজন প্রকৃত লিটলম্যাগ কর্মী সাহিত্যিক সাজেন না। সাহিত্যিক হওয়ার প্রত্যয় লালন করেন। বর্তমানে বাংলাদেশে কালো ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট গড়ে উঠতে দেখি অবৈধভাবে বেশি লাভবান হওয়ার জন্য। প্রতারিত হয় ভোক্তাশ্রেণী। একইভাবে কিছু কিছু লিটলম্যাগ সম্পাদক গড়ে তোলেন সিন্ডিকেট। যাদের সামর্থের আর যোগ্যতার ঘাটতি থাকে সিন্ডিকেট তারাই গড়ে তোলে। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তুমি-আমি চর্চা হয়, প্রকৃত লিটলম্যাগ চর্চা হয় না। গোষ্ঠিবদ্ধতা হতেই পারে। যদি তা হয় আদর্শের জায়গা থেকে তবে একটি লিটলম্যাগকে কেন্দ্র করে একটি গোষ্ঠি গড়ে ওঠে। খারাপ লাগে সেই সময় যখন দেখি গোষ্ঠিবদ্ধতা পলিটিক্সে রূপ নেয়। একে অন্যকে হেয় করে, উড়িয়ে দেয়। এর ফলে লিটল ম্যাগ সম্পাদকদের মধ্যে বিভিন্ন গ্রুপ সৃষ্টি হয়েছে। গ্রুপিং চর্চা লিটল ম্যাগ আন্দোলনের জন্য শুভকর নয়।
রাফাতুল আরাফাত: ভাই, দেখবেন ১৯৩০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত— বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস থেকে কৌশলে ব্যাক্তিগত প্রয়াস বা একজন কবির একা চলার বিষয়টি বাদ দেয়া হয়েছে...
শিকদার ওয়ালিউজ্জামান: বেশিরভাগ মানুষই দলবদ্ধ হয়ে থাকতে চায়। সাহিত্যপাড়াও এর ব্যতিক্রম নয়। ত্রিশ এর আগে কবি-সাহিত্যিকগণ একক প্রচেষ্টাতেই সাহিত্য চর্চা করেছেন। এক একটি বটবৃক্ষও হয়ে উঠেছেন। তবে অন্যের সাথে সম্পর্ক ছিল কিন্তু কোন দল বা গোষ্ঠি ছিল না। ত্রিশের পর থেকেই এমন চর্চা দেখতে পাই। পাশ্চাত্য সাহিত্যে অনেক আগে থেকেই সমধারার একটি লেখকগোষ্ঠি দেখতে পাই। রোমান্টিক কবিগণ তার এক বাস্তব উদাহরণ। Lake Poets, Harlem Rene issuance এক একটি গোষ্ঠিভিত্তিক চর্চার ফসল। এত কিছুর মধ্যেও প্রকৃত কবিসত্তা সব সময় একাকীত্ব বোধ করেন। একাকীত্বই তার সাধনা। প্রতিটি কবিতাই কবির ব্যাক্তিগত প্রয়াস। এই প্রয়াস কিংবা একা হওয়ার ধ্যান বাদ দেওয়ার বিষয় নয়। জীবনানন্দ সবার মাঝে থেকেও তো তিনি একা হয়ে গিয়েছিলেন। হয়তো গোষ্ঠিক চর্চা বা সংগঠন ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকে। তাই বলে কোন একা জ্বলে ওঠা আগুনকে ইতিহাস কি অস্বীকার করতে পারে? বারুদ থাকলে আগুনতো জ্বলবেই...
রাফাতুল আরাফাত: কবিতার ধারণা কি বদলে যাচ্ছে? বব ডিলান সঙ্গীত শিল্পী হয়ে সাহিত্যে নোবেল পেলেন..
শিকদার ওয়ালিউজ্জামান: বব ডিলান এর নোবেল পুরস্কার পাওয়াটা বিস্ময়কর কিছু নয়। তিনি বিংশ শতাব্দির অন্যতম শ্রেষ্ঠ গীতিকার। তিনি গানে গভীর বোধ এনেছেন। আমেরিকান সংস্কৃতিতে তিনি জোরালো প্রভাব ফেলেছেন। ২০০৮ সালে তিনি পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি গানে অসাধারণ কাব্যিক শক্তির স্বাক্ষর রেখেছেন। গান তো কবিতাই । ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি কিন্তু আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরির একটি কবিতা। কবিতাটি মানুষের হৃদয়ে গেঁথে গেছে, গান হয়ে মানুষের ঠোঁটে পৌঁছে গেছে। বব ডিলান এমন তোলপাড় করা গান অনেক রচনা করেছেন। তারই স্বীকৃতি নোবেল পুরস্কার। এ্যালেন গিনেসবার্গ বব ডিলানের গান শুনে লিখেছিলেন, ‘I heard 'Hard Rain'- and wept. Because it seemed that the torch had been passed to another generation, from earlier bohemian, and Beat illumination.'
নীরিক্ষাক্ষেত্রের যত ঝুঁকি তা মেনে নিয়েই কবিকে তার কবিতায় ভাবগত ও ভাষার পেলবতা রাখতেই হয়। পাঠককে সেখানে নিয়ে যাওয়ার পথটাও কিন্তু কবিকেই নিতে হবে। ধাপে ধাপে
রাফাতুল আরাফাত: ইদানিংকালে একটা টার্ম খুব শোনা যায়। বা আগেও ছিলো টার্মটা। পরীক্ষামূলক সাহিত্য। সাহিত্য কি গবেষণাগার? আপনার কি মনে হয়?
শিকদার ওয়ালিউজ্জামান: দেখ, শীত যাবার কালে প্রকৃতি তার অনেক আবরণ ফেলে দেয়। বসন্তের আগমনে নতুনের সাজে মেতে ওঠে প্রকৃতি। পরিবর্তন এবং বিবর্তন সবকালেই ছিল। পরিবর্তন ইচ্ছে করে আনতে হয়। আর বিবর্তন কালের পরিবর্তনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে হতে থাকে আমাদের দৈনন্দিন সামাজিক ও সংস্কৃতিক জীবনে। পরিবর্তন বা বিবর্তন যাই বলি না কেন সেটাকে মেনে নেওয়াটাই ইতিবাচকতা। এই ইতিবাচকতা থেকে তৈরি হয় মননশীলতা। তুমি বলছো পরীক্ষামূলক সাহিত্য। নীরিক্ষামূলক সাহিত্য পরিক্ষামূলক সাহিত্যের উল্টো। পরিক্ষামূলক সাহিত্য যদি বলি, তা হলো চলমান সাহিত্য নিয়ে গবেষণার একটি ফল। এই ফল তিক্ত ও মধুর দুই-ই হতে পারে। নীরিক্ষামূলক সাহিত্য এক ধরণের চ্যালেঞ্জ। নতুন কিছু করার প্রয়াস। কবি তো নতুন নতুন ফর্ম, নতুন নতুন ধারণা জন্ম দেওয়ার প্রয়াস করবেনই। তা যদি তিনি না পারেন, তবে তিনি সেখানেই আটকে থাকবেন। সময় তো বহমান। এই বহমানতার সাথে সাথে কবিতাও তার নতুন আশ্রয় খোঁজে। নীরিক্ষাকে ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। এই অপেক্ষা ব্যর্থ হয়ে যায় যদি পাঠক সময়ের প্রবাহমানতার সাথে তাল মেলাতে না পারে। এই নীরিক্ষাকে অনেকে দুর্বোধ্যতার দায়ে দুষ্ট করে থাকেন। অপ্রচলিত পথে যদি প্রথমে হাঁটতে যাও সেই পথকে কী দুর্গম/অচিন মনে হয় না? নীরিক্ষাক্ষেত্রের যত ঝুঁকি তা মেনে নিয়েই কবিকে তার কবিতায় ভাবগত ও ভাষার পেলবতা রাখতেই হয়। পাঠককে সেখানে নিয়ে যাওয়ার পথটাও কিন্তু কবিকেই নিতে হবে। ধাপে ধাপে। তাই নীরিক্ষা-দুর্বোধ্যতা-পাঠকপ্রিয়তা কখনো সমান্তরাল কখনো অগোছালো।
রাফাতুল আরাফাত: সত্যের সংজ্ঞা কী আপনার কাছে? সত্য বলে কিছু আছে আদৌ ? কবিতায় সে কি আছে ? থাকতে পারে ?
শিকদার ওয়াউিজ্জামান: সত্য হলো ঘটনা বা বাস্তবতা। কবিতা এক সাহিত্যকর্ম যেখানে স্বতন্ত্র ভঙ্গিতে আর ছন্দে আবেগ এবং ধারনা প্রকাশে জোর দেওয়া হয়। সত্য প্রায়ই তিক্ত হয়ে থাকে। তিক্ততার পরে মিষ্টতা থাকতেও পারে, নাও পারে। তাই মানুষ সত্যকে এড়িয়ে যেতে চায়। মানুষ কবিতাকে অপছন্দ করলেও তার পাঠ থেকে বিরত থাকে। তবে কবিতার শক্তি এখনও যেমন, শত বছর আগেও এমনই ছিল। সত্যের বিপরীতে যেমন মিথ্যে থাকে তেমনই কবিতারও দুইটি রূপ আছে। ভালো কবিতা আর খারাপ কবিতা। কীসে একটি কবিতাকে ভালো করে তোলে তার অনেক তর্ক-বিতর্ক আছে। কিন্তু আমার মতে, কবিতার স্বকীয়তাই মুখ্য যা অনুত্তীর্ণ কবিতা থেকে আলাদা করে। স্বকীয়তার জন্য দরকার অর্থের আবরণে কবিতাকে আচ্ছাদিত করা। এই অর্থ সত্যের একটি রূপ। এর স্বরূপ নিরাকার ঈশ্বরের মতো। মানা আর না মানা একান্তই তোমার। তোমাকে একটি উদাহরণ দিই
'Twinkle Twinkle Little Star ' কবিতাটি Jane Taylor লিখেছিলেন ১৮০৬ সালে। ২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে লক্ষ লক্ষ শিশুর মুখে উচ্চারিত হয়েছে। ছোটবেলায় আমরা সত্যের কিয়দাংশ শুনেছি, কিন্তু যখন সত্যের ভার বহন করতে আমরা বাধ্য হই তখন সত্য হয়ে ওঠে আমাদের অভিজ্ঞতা আর গল্প। সেই গল্প থেকেই বেরিয়ে আসে এক একটি কবিতা। অন্যদিকে সত্য কবিতার মতো অর্থবাহি। কবিতা আর সত্য উভয়ই সময় ধরে চলে, সময়ের গণ্ডি পেরনো তীরও বলতে পারো। সত্য কবিতার মতো এবং অধিকাংশ মানুষ কবিতাকে অপছন্দ করে। কিন্তু তুমি যদি কবিতা পছন্দ করো, এটা তোমার হবে, তোমার সাথেই কথা বলবে সব সময় অর্থবহ হবে। বিষয়টি কীটস এর সাথে মেলানো যায়, 'Beauty is truth, truth beauty.' সত্য বাদে পুরোপুরি কল্পনার উপর ভিত্তি করে কবিতা লেখা যায় না।
রাফাতুল আরাফাত: ভাই, কবিতা যদি টাইপোগ্রাফি ভেঙে ফেলে, অক্ষরের বাইরে চলে আসে- কেমন লাগে আপনার ? ধরুন দৃশ্য-কবিতা-ভিস্যুয়াল পোয়েট্রি-
শিকদার ওয়ালিউজ্জামান: ভাই, এটি এমন প্রশ্ন যা একজনকে ধাঁধাঁয় ফেলে দেয়। অনেকেই টাইপোগ্রাফিকে আঁকড়ে আছেন, কবিতা লিখছেন। আবার অনেকে টাইপোগ্রাফি ভাঙছেন। পাশ্চাত্য কবিতায় ১৯৫০ এর পর এই ভাঙন চললেও বাংলা কবিতায় টাইপোগ্রাফি ভাঙার প্রয়াস একবিংশ শতাব্দির গোড়া থেকেই কবিরা করে যাচ্ছেন। অক্ষরের বাইরে আসা যায় এমন কবিতাও লিখছেন কেউ কেউ। অক্ষর ভাঙার নতুন আন্দোলনও দানা বাঁধতে শুরু করেছে ইতোমধ্যেই। আমি এক্ষেত্রে মধ্যপথ অবলম্বন করি। টাইপোগ্রাফি ভাঙতে গিয়ে কবিতার নতুন ফর্ম দাড়াচ্ছে তা হলো দৃশ্য কবিতা ও ভিজুয়াল পোয়েট্রি। তিনের পক্ষেই যুক্তি আছে। স্টিলম্যান বলেছেন, 'the line is a unit of language in a poem.' এরই সমর্থনে বার্নার্ড নিউডিগ্রেড বলেন, “jagged ends of the verse [of poetry] are a condition which no printer’s ingenuity can control.” অন্যান্য আরো বিষয় যেমন পংক্তিবিন্যাস, মুদ্রণ অবচ্ছেন, চলমান ব্যাকরণ বিকৃতি কবিতাকে মুদ্রিত কোন রচনারীতি থেকে আলাদা করে। বিশেষ করে পোস্টমডার্ন যুগে কবিতার পুরনো ঐতিহ্যকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
আবার দৃশ্য কবিতার শব্দ কতটুকু দৃশ্য এই প্রশ্ন আসতেই পারে। পড়তে না পারলে কি আমরা শব্দদের দৃশ্য ভেবে নিই? অপাঠ্যতা কি ভাষালিপির আকর? এমন সব প্রশ্ন বর্তমান সময়ের অনেক পাঠকের। সিগমান্ড ফ্রয়েড এর ভাষায়, Image কে Syllable বা Word দিয়ে ভাবলে তবেই স্বপ্নচিত্রের অর্থ প্রকট হয়, না হলে তাকে অর্থহীন মনে হয়। কোন কবিতা অপাঠ্য হলে শব্দেরা দৃশ্যের শবদেহ হয়ে যায়। আমরা যখন কোন শব্দ দেখি, সবার আগে দেখি, তারপর পড়ি। তখন অর্থ উদ্ধারের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই সাক্ষাতে শব্দের শরীর কেবলই দৃশ্য হিসাবে আমাদের চোখে ভাসে। শব্দ-দৃশ্য-ভাব এই তিনের সমন্বয়ই যুৎসই কবিতা তৈরি করে। চিত্রকর উইলিয়াম ব্লেক বা গুন্টার গ্রাস ক্যানভাসেই কবিতা লেখেন। কিংবা পাতাকেই ক্যানভাস বানিয়ে টেক্সট আর ইমেজের মৈত্রি ঘটান। দৃশ্য আর শব্দ প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।
অনেকেই ভিজুয়াল কবিতা কবিতাকে কংক্রিট কবিতা থেকে আলাদা করেছেন আবার অনেকে মিশেল ঘটিয়েছেন। আমি মিশেলের পক্ষে। মারভিন এ স্যাকনার বলেছেন, কংক্রিট কবিতা হলো তাই যেখানে বর্ণ ও শব্দের সন্নিবেশ ঘটানো হয় একটা দৃশ্যমান রূপ দিতে; যেখানে ভিজুয়াল কবিতায় কিছু দৃশ্যের সমাবেশ ঘটানো হয় কবিতার অবয়বে। Klaus Peter বলেন, কংক্রিট কবিতা এবং ভিজুয়াল কবিতা পরস্পর সম্পর্কিত। তার ভাষায় কংক্রিট কবিতা ছাড়া ভিজুয়াল কবিতার বর্তমান কাঠামো চিন্তাতীত। Willard Bohn কবিতার সংজ্ঞা দিয়েছেন এইভাবে, ভিজুয়াল কবিতা দৃশ্যমান যেখানে দর্শক আর পাঠক একাকার হয়ে যায়। তাই কেউ সচেতন না হয়ে কিংবা অজ্ঞানে টাইপোগ্রাফী ভাঙতে চাইলেই হবে না। এই ক্ষেত্রে সফল নীরিক্ষা ও পঠনের প্রয়োজন হয়।
প্রত্যেক সত্যই গৃহীত সত্য। সেটি ভুলও হতে পারে, আবার সঠিকও হতে পারে। এ এক ভিন্ন ভিন্ন বিবেচনা। বিবেচনার কোন একক মানদণ্ড নেই।
রাফাতুল আরাফাত: কবিতার ক্ষেত্রে অনেকেই নতুনত্ব আনার চেষ্টা করছে। গাণিতিক কবিতা, জ্যামিতিক কবিতা, ত্রিকোনমিতিক কবিতা, ক্যালকুলাস কবিতা, পাটিগণিত কবিতা, বীজগাণিতিক কবিতা...এগুলোকে কীভাবে দেখেন?
শিকদার ওয়ালিউজ্জামান: জাগতিক যা কিছু দেখছো তার প্রত্যেকেরই নিজস্ব ঢং আছে। প্রত্যেকে তার নিজ ঢংয়েই নিজেকে প্রকাশ করে। কবি নিরীক্ষাপ্রবণ। মূর্ত-বিমূর্ত সকল ভাষার মধ্যেই কবিতার সুর খোঁজেন তিনি। এই খোঁজ করার ভাষা যদি শিল্পগুণ লাভ করে পাঠকনন্দিত হতে পারে তাতে দোষের কিছু দেখছি না। তবে পুরুষকে শাড়ী পরিয়ে নারীসাজে সাজালেও নারীর কোমলতা সে লাভ করতে পারে না। কবিতার ভাষাব্যবহারও তেমন। যা যেখানে মানানসই তার সফল প্রয়োগই সকল বিব্রত অবস্থার উর্দ্ধে থাকে।
রাফাতুল আরাফাত: ভাই, একজন কবির গদ্য লেখাকে কীভাবে দেখেন আপনি?
শিকদার ওয়ালিউজ্জামান: দেখ ভাই, কবির চোখ কিন্তু শকুন চোখ। সে গভীরের ভেতর আরো গভীরতা খোঁজে। কবি ধ্যানী। কল্পনার রাজ্য তার সিমাহীন। ভাবনার সাথে পঠন-পাঠন ঋদ্ধ হলে কবির কাছ থেকে আমরা যেসব গদ্য পাবো তা আর কারো কাছেই আশা করতে পারি না। যে সকল কবি কবিতার পাশাপাশি গদ্য লিখেছেন তা প্রাঞ্জল ও ঝরঝরে। সে সব গদ্য কখনো শব্দের ভারে নুইয়ে পড়ে নি। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, সৈয়দ আলী আহসান, আল মাহমুদ, আব্দুল মান্নান সৈয়দ, হুমায়ুন আজাদ, হায়াৎ মামুদ, খোন্দকার আশরাফ হোসেন, মুহম্মদ নুরুল হুদা, ঝর্ণা রহমান, মাসুদুজ্জামান, মাসুদুল হক, মাহবুব সাদিক, শোয়েব শাহরিয়ার, হেনরি স্বপন, শিবলী মোকতাদির, সরকার আমিন, তারিক টুকু, জাহিদ সোহাগ, রিঙকু অনিমিখ, মোজাফফর হোসেন প্রমুখ কবিগণের হাতে যে সব গদ্য লেখা হয়েছে তা কখনো ক্লান্তি সৃষ্টি করে না। তাই প্রত্যেক কবি যদি কবিতা লেখার পাশাপাশি গদ্য লেখার হাত পাকান তাহলে বাংলা সাহিত্য আরো সমৃদ্ধ হবে বলে মনে করি।
রাফাতুল আরাফাত: আমরা প্রায় সময়ই শুনে থাকি মহৎ সাহিত্য বা চিরকালের সাহিত্য। মহৎ সাহিত্য বা চিরকালের সাহিত্য বলতে কি আদৌ কিছু আছে? সকল সাহিত্যই কি সে কালের বা সময়ের নয়?
শিকদার ওয়ালিউজ্জামান: মহৎ সাহিত্য তো আছেই। মহৎ কবিতা টার্মটি জীবনানন্দ দাশ তার ‘কবিতার কথা’ প্রবন্ধগ্রন্থে ব্যবহার করেছেন। মহৎ সাহিত্যের পরিপূরক হতে পারে ‘চিরকালের সাহিত্য’। মহাকালের স্বীকৃতি পেলেই কোন কবিতা বা সহিত্য চিরকালের হয়ে যায়। দেখ ভাই, থিম হলো কবিতা বা সাহিত্যের নার্ভ। থিমের মাধ্যমেই কবি-সাহিত্যিকের বার্তা পৌঁছে যায় পাঠকের কাছে। যখন কোন থিম বা বিষয় বিপুল পাঠকের সাথে সম্বন্ধি হয়ে যায় তা বিশ্বজনীনতা লাভ করে। ‘বিশ্বজনীন সাহিত্য’ গনমানুষের জীবনের সাথী হয়ে যায় যা পাঠক সহজেই গ্রহণ করতে পারে। এখানে একাকার হয়ে মিশে থাকে মানবিকতা, প্রেম, জীবনচক্র, কর্ম, বিয়োগ, বয়:সন্ধির তাড়না, পৃথিবী বিজয়ের পিপাসা। থিমগুলো পাঠক নিজ জীবনের অংশ মনে করে। তখনই তা মহৎ সাহিত্যে মোড় নিতে থাকে। চিরকালীন শব্দটিকে তুমি মৃত্যুর মতো সত্য মনে করতে পারো। জীবনানন্দের বনলতা সেন কবিতাটি চিরকালীন সুর বাজিয়েছে কারণ সেখানে এমন একটি লাইন আছে, ‘সব পাখি ঘরে আসে- সব নদী- ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন;/থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।’ মহৎ সাহিত্য সব সময়ই আধুনিক। বহমান স্রোতের মতো গড়িয়ে যায়...
রাফাতুল আরাফাত: তত্ত্ব ও দর্শন এই দুইটা জিনিসকে অনেকে গুলিয়ে ফেলছেন। তত্ত্বকে অস্বীকার করতে গিয়ে অনেকে দর্শনকে অস্বীকার করে ফেলছেন। কবিতা কি এক প্রকার ব্যাক্তি দর্শনই নয়?
শিকদার ওয়ালিউজ্জামান: প্রত্যেক সত্যই গৃহীত সত্য। সেটি ভুলও হতে পারে, আবার সঠিকও হতে পারে। এ এক ভিন্ন ভিন্ন বিবেচনা। বিবেচনার কোন একক মানদণ্ড নেই। দর্শনকে অস্বীকার করার কিছু নেই। দর্শনের বিরোধিতাও আসলে দর্শন। কবিতায় কি আসলে তত্ত্ব খাটে? কবিতা তো এক প্রকার জিজ্ঞাসা রেখেই যায়। কোন পরিণতি টানে না। দর্শনও জীবন আর অস্তীত্বের অর্থ খোঁজে। দার্শনিক তথ্য আর যুক্তি দিয়ে একটি প্রক্রিয়া দাড় করায় সেটাই তার তত্ত্ব। একজন ব্যক্তি কবি ও দার্শনিক উভয়ই হতে পারে। কারণ কৌতুহল আর সন্ধানই হলো উভয়ের ভাষা। দার্শনিকের চলে সত্যের গবেষণা, কবি করেন সত্যের আরাধনা। এই আরাধনার জগতে বিচরণ করতে করতে যে পথে কবি তার প্রকাশ ঘটান সেটাই তার নিজস্ব দর্শন। কবির প্রকাশ কখনো রূপকাশ্রয়ি কখনো বিমূর্ত।
রাফাতুল আরাফাত : দশক ধারণা বা টাইম স্কেলকে কীভাবে দেখেন আপনি?
শিকদার ওয়ালিজ্জামান: কালের বিচারে দশ বছর হয়তো কিছুই নয়। কিন্তু আমাদের সংক্ষিপ্ত জীবনকালে সময়ের পরিক্রমায় অনেক কিছুরই বিবর্তন হয়। ধরো আমার শৈশব কাটলো মাটির সখ্যতায়, নদীর স্রোতে খেলা করে। ১০/২০ বছরের ব্যবধানে মাটির বারান্দা উধাও, ঘাট উধাও, নদীর চার উধাও। স্রোত আর চরের ভাষা এক হতে পারে না। কবিতার দশকও তেমনি। ত্রিশের কবিরা রবিন্দ্র-নজরুলের ধারা থেকে বেরিয়েছেন। চল্লিশেই আবার পরিবর্তনের সুর। পঞ্চাশ আর ষাটে কবিতার নতুন মোড়। ঠিক সেইভাবে আশির-নব্বই-র কবিতা আর শূন্যের কবিতা এক নয়। দেশ, সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতি, অর্থনীতির সময়ের চাকায় আবর্তিত হয়। কবিতার গতি ও প্রগতি সেই পরিবর্তনের ছাপ রেখেই যায়। সময়ই আসলে আমাদেরকে টেনে নিয়ে যায়।
রাফাতুল আরাফাত: অনেকে সরাসরি বলেন, বুদ্ধদেব বসু পশ্চিমাদের থেকে এটি আমদানি করেছেন। সাহিত্যের ক্ষেত্রে কি দেশের বা সংস্কৃতির সীমারেখা থাকা উচিত?
শিকদার ওয়ালিউজ্জামান: পশ্চিমা বিশ্বে দশকীয় সাহিত্যের চর্চা আছে কিনা আমার জানা নেই। বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে পঞ্চপাণ্ডব নামে খ্যাত হয়েছেন তাদের নিজস্ব কীর্তিতেই। এই কারণে ত্রিশের দশক পঞ্চপাণ্ডবদের দশক হতে পারে। এমন স্বীয় কীর্তিতে আর কোন দশক তৈরি হয় নি। ত্রিশের আগে রবীন্দ্রযুগ ছিল তার রবীন্দ্রনাথের দ্যুতিতেই। এভাবে ইংরেজি সাহিত্যে এলিজাবেথি যুগ, ভিক্টোরিয়ান যুগ হয়েছে কিন্তু দশকীয় সাহিত্য নেই। বাংলা সাহিত্যেও বিভিন্ন যুগ এসেছে। কিন্তু ত্রিশের পর বাংলাদেশের সাহিত্যে দশকীয় একটি রোগে পেয়ে বসেছে। আমরা তারই রেশ টানছি। সংস্কৃতির সীমারেখা থাকতে পারে কিন্তু সাহিত্য সার্বজনীন। সকল কালে, সকল যুগেই মানুষের হৃদয়ে তার বাস।
রাফাতুল আরাফাত: দ্বিতীয় দশকের কবিতায় এসে কি কবিতা আমূল বদলে যাচ্ছে? ষাটের দশকের পর কবিতার ধারণাই যেমন বদলে গিয়েছিল..
শিকদার ওয়ালিউজ্জামান: কবিতা দশকে দশকে খুব একটা বদলায় না। সংস্কৃতি চলমান ধারার মতো। এই চলমানতা থেকেই জীবন বদলে যায়, সংস্কৃতি পাল্টায়, কবিতার ধারারও পরিবর্তন হয়। তবে সংস্কৃতি ও কবিতার ধারা বদলাতে কমপক্ষে ত্রিশ বছরতো নিয়েই থাকে। ত্রিশের ধারার পর চল্লিশ ও পঞ্চাশ গেছে। ষাটে এসে কবিতার নতুন স্বাদ পায় পাঠক। এই ধারাতে সত্তর ও আশি গেছে। বক্তব্যই ছিল তাদের কবিতার ভাষা। নব্বইয়ে এসে কবিতা বহুমাত্রিকতা পেতে শুরু করে। সে পথেই হেঁটেছে শূন্য দশকের কবিগণ। দ্বিতীয় দশকতো ট্রানজিশনাল দশক। কেউ কেউ শূন্যের ধারায় লিখেছে আবার কেউ কবিতায় নতুন মাত্রা যোগ করার প্রয়াস চালিয়েছে। তৃতীয় দশকে কবিতার স্বর বদলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই বদল শুরু করার দাবি করতেই পারে দ্বিতীয় দশকের কবিদের কেউ কেউ, সবাই নয়। চলে যাওয়া দশকে কিন্তু এমন চর্চা কম হয়েছে। বদলচর্চার প্রচণ্ডতা শুরু হয়েছে মাত্র। পূর্ণতা পাবে তৃতীয় দশকে।
রাফাতুল আরাফাত: এখন কবিতায় প্রচুর ইংরেজি শব্দ ব্যাবহার হচ্ছে। ইংরেজি বাক্য ব্যবহার হচ্ছে। কবিতায় সরাসরি কোটেশন ব্যাবহার করা হচ্ছে..
শিকদার ওয়ালিউজ্জামান: অনেকে কথায় কথায় ইংরেজি শব্দ আওড়িয়ে পাণ্ডিত্য ফলানোর চেষ্টা করেন। এটি অনেকের কাছেই বিরক্তিকর মনে হতে পারে। কবিতাতেও এমনটি হচ্ছে না তা বলি কীভাবে? কবিতায় বিভিন্ন ভাষার মিশেল হতেই পারে। যদি কবিতার কোন চরণ এমনটি দাবি করে। বিভিন্ন কবি করেছেন। ইংরেজি ভাষাকে সর্বজ্ঞান করলে তোমার ভাষাকে কি ছোট করা হয় না? কবিরা তো শব্দ তৈরির কারিগর। বাংলা ভাষা থেকে বোধের চর্চায় এমন শব্দ ব্যবহার করো তাতে তোমার ভাষা সমৃদ্ধ হবে। কিন্তু আরোপিত ইংরেজি শব্দ প্রয়োগ কবিতাকে ব্যক্তিত্বহীন করে দেয়। মহাকাল নিজের আঙিনা ছেড়ে অন্যের আঙিনায় পাণ্ডিত্য জাহিরকে স্বীকৃতি দিতে পারে না।
রাফাতুল আরাফাত: ভাই, এখন কবিতার যৌনতা খুব বেশি আসছে। অনেকেই দ্বিতীয় দশকের কবিদের অশ্লীল বলছেন। কবিতা শ্লীল অশ্লীল বিবেচনা হবে কোন বিষয়গুলোর উপর ভিত্তি করে? বা কারা শ্লীল অশ্লীল এটা ডিক্লেয়ার করবে?
শিকদার ওয়ালিউজ্জামান: কবিতার বিচারক পাঠক আর মহাকাল। যে কোন শব্দই কবিতাতে আসতে পারে। ইচ্ছাকৃত বা বিশেষ উদ্যেশ্যে পাঠককে যৌন সুড়সুড়ি দেওয়াটাই হলো অশ্লীলতা। তবে এটাও কারো কাছে উপজীব্য হতে পারে। সেটা নির্ভর করে পাঠকের রুচির উপর। যৌন শব্দের অপপ্রয়োগই হলো অশ্লীল কবিতা। তবে ঐ শব্দের সফল প্রয়োগে সেটা আর অশ্লীলতার পর্যায়ে থাকে না। কবিতার পৃথিবীতে সাদা-কালো উভয়েই শিল্পমূল্য সৃষ্টি করতে সক্ষম। দ্বিতীয় দশকের কবিদের অশ্লীল বলার কোন সুযোগ নেই। তাদের ভাণ্ডারেও যুক্তির অভাব নেই। বিষয়টি অগ্রজদের মেনে নেওয়ার বিষয়।
রাফাতুল আরাফাত : কথাসাহিত্যিক মোজাফফর হোসেন একটা সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, বাংলা সাহিত্যে যৌনতার ভাষা তৈরি হয়নি..
শিকদার ওয়ালিউজ্জামান: মোজাফ্ফর ভুল কিছু বলেনি। তুমি দিনের সুন্দরকে উপভোগ করবে যদি রাতের দীর্ঘশ্বাসকে উপলব্ধি করতে পারো। বিপরীতে রাত তোমাকে যে শান্তি আর স্বস্তি দিতে পারে তার মাহাত্মকে বুঝার ধীশক্তি তোমার থাকতে হবে তো। যৌনতা জীবনেরই একটা অংশ। তাকে তুমি অস্বীকার করবে কীভাবে? সাহিত্য আকাশেও ভাসে, পাতালের কৌতুহলও পূরণ করতে চায়। কোন জাতি ধর্মান্ধতার চাদর গায়ে জড়িয়ে থাকলে উদার সংস্কৃতির ভাষা ভুলতে থাকে। ফুলতো অনেকেই বাগান থেকে ছিড়ে ফুলদানিতে রাখে কিন্তু তার বেঁচে থাকার আয়ুষ্কাল কতো? সাহিত্যের ভাষা সাদা আর কালোকে সমান্তরাল করতে চায়। বাংলা ভাষাভাষিদের ক্ষেত্রে এমন চর্চা গড়ে ওঠেনি।
সমালোচনা হতে হবে সাহিত্যকর্মের। কারো ব্যক্তিগত সত্তাকে নয়। বাংলাদেশের সমালোচনা সাহিত্য বেশ দূর্বল। সাহিত্যের সমালোচনা হতে হবে ভালো-মন্দের দিকদর্শি। হতে হয় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। তবেই না কোন সাহিত্যকর্ম স্থায়িত্ব পায়।
রাফাতুল আরাফাত: সাহিত্যের অনেক শাখাই কিন্তু বাংলা সাহিত্যে সেভাবে বিকশিত হয়নি। ফেবল, প্যারাবল, স্যাটায়ার..
শিকদার ওয়ালিউজ্জামান: ফেবল সাহিত্যের একটি অন্যতম শাখা। ফেবল হলো প্রাণীদেরকে মনুষ্যচরিত্রের আড়ালে রেখে এক ধরণের গল্প তৈরি করা হয়। গল্পটি শেষ হয় একটি নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে। কৌশলটি গল্প এবং কবিতা উভয়ের ক্ষেত্রের প্রযোজ্য হতে পারে। গাছ, প্রাণী, প্রাকৃতিক শক্তিসমূহকে ফেবলের চরিত্র হিসাবে ফুটিয়ে তোলা হয়। এখন আসি বাংলা সাহিত্যে এর বিকাশ হয়েছে কিনা। আমি বলবো সাহিত্যের এই শাখাটিতে বাংলা কবিতা বা গল্প এখনও পিছিয়ে আছে। গ্রাম বাংলায় মা-দাদিরা কোলে বসিয়ে শিশুদের যে প্রাণীকুলের গল্প শোনাতেন (এখন আধুনিক মায়েরা অবশ্য তেমন গল্প জানেন না) ঐগুলোই বাংলা সাহিত্যের ফেবল হিসাবে ধরা যায়। মুখে মুখে প্রচলিত সেই গল্পগুলো হারাতে বসেছে। ওগুলো সংরক্ষণের জন্য কোন প্রাতিষ্ঠনিকতা এখনও পর্যন্ত দাঁড়ায়নি। আমাদের শিশুতোষ সাহিত্যিকগণ ভূত এবং কিছু ক্ষেত্রে বাঘ, সিংহ এবং কুমিরকে নিয়ে গল্প রচনা করে যাচ্ছেন। আমাদের শিশুদের গল্প শোনানোর জন্য ঈশপের গল্পের উপর নির্ভর করা লাগে।
প্যারাবল বিষয়ে আমাদের অনেকেরই এখনও স্পষ্ট ধারণা নেই। প্যারাবলেও নৈতিক শিক্ষা থাকবে। তবে সেই শিক্ষার মধ্যে কোন উপদেশ থাকবে না। ইতিহাস বা কোন লোকজ গল্পও নয়। প্যারাবলের যে নৈতিক শিক্ষা সেখানে মনীষীদেরকে ঘিরে একটি গল্প তৈরি হবে। সেই গল্পে অন্য চরিত্রও থাকবে। সর্বশেষ ঐ গল্প থেকে একটি নৈতিক শিক্ষা লাভ করবে পাঠক। জর্জ অরওয়েলের এনিমেল ফার্ম একটি প্যারাবল। মহাভারত, বাইবেল প্যারাবলের আদি উৎস। মহানবী হযরত মুহম্মদ এবং বুড়ির পথে কাঁটা বিছানোর গল্পটিও একটি প্যারাবল। ধর্মীয় কিছু প্যারাবল ছাড়া বাংলা সাহিত্যে প্যারাবল এখনও স্পষ্টতা পায় নি।
স্যাটায়ারের প্রয়োগ কিন্তু বাংলা সাহিত্যে হয়েছে সেই প্রাচীন যুগ থেকেই। মানুষ সমাজের সবচেয়ে কার্যকরী অধ্যায়। মানুষই মহৎ কাজ করছে আবার এই মানুষই নিকৃষ্ট জীবের পরিচয় দিয়ে থাকে। মানুষের সমাজেই মানুষের বাকরুদ্ধ হয়। সৃষ্টি হয় জড়বুদ্ধি ও অনাচার। এই সব পাপাচারকে কৌশলে Irony বা Humour এর মাধ্যমে শুধরানোর চেষ্টা করা হয়। সে চেষ্টা উপন্যাসিক করেন, কবি করেন, চলচ্চিত্র নির্মাতাও করে থাকেন। স্যাটায়ার এর মাধ্যমে মিথ্যে রাজনীতি, রাজনীতিক ও ধর্মীয় বিশ্বাসকে আক্রমন করা হয়। সেটাতো আমাদের বাংলা সাহিত্য, কবিতা ও চলচ্চিত্রে চলমান আছে। কার্টুনিস্ট তার কার্টুনে স্যাটায়ারের সফল প্রয়োগ করেছেন। রনবি অর্থাৎ রফিকুননবীকে আমরা ভুলিনি নিশ্চয়ই। রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের পর জীবনানন্দ, ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত, প্রমথ চৌধুরী, পরশুরাম, সৈয়দ মুজতবা আলী, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, আবুল মনসুর আহমেদ প্রমুখ কবি-সাহিত্যিকগণ স্যাটায়ারের সফল প্রয়োগ করেছেন। একুশ শতকের কবিতায় স্যাটায়ার প্রয়োগে ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে।
রাফাতুল আরাফাত: ভাই, পোস্টমর্ডাণ, পোস্টকলোনিয়াল এই শব্দগুলোকে কীভাবে দেখেন? পাণ্ডিত্য জাহির করতেই কি একটা শ্রেনী এই শব্দগুলো সামনে নিয়ে আসছে?
শিকদার ওয়ালিউজ্জামান: Post modern বলো আর Post colonial বলো সবই পাশ্চাত্য সাহিত্য থেকে ধার করা। Post modernism হলো একটি ধারণার নাম। এই ধারণাটি ইতোমধ্যে বেশ বিতর্কের জন্ম দিয়ে ফেলেছে ফেলেছে। এর প্রবণতা বুদ্ধিবৃত্তিক, শৈল্পিক বা সাংস্কৃতিক চর্চাকে সন্দেহের চোখে দেখে এবং বৈচিত্র, দ্ব্যর্থকতা, বিরোধিতা আর দুর্বোধ্যতাকে সহজেই মেনে নেয়। Post modernism সব সবসময় অস্তিত্ববাদ, জ্ঞান আর ইতিহাসের কালকে ঘিরে রাখা ধারণাকে আক্রমন করে। বলতে পারো Modernism এর ধারণার বিপরীতে চলাই Post Modernism এর লক্ষ্য। Post colonial শব্দটি উচ্চবিলাশি নয়। যে কোন দেশই স্বাধীনতার পরও উপনিবেশিক প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারে না। সাহিত্যের ক্ষেত্রটিও তার বাইরে নয়। এই প্রভাব থেকে বেরোতে বেশ সময়ের দরকার। আধুনিক সময়ে উত্তর-উপনিবেশিক বাংলাদেশ তার সাহিত্যে নিজস্বতা অর্জন করছে। বহুবর্ণিল রাজনৈতিক বাংলাদেশে সাহিত্যের পথও বহুরেখায় বিচরণ করছে। পাণ্ডিত্য জাহিরের বিষয় নয়, বরং তোমার দেশের সাহিত্যকে তো প্রাচ্য-পাশ্চাত্য-আফ্রো সাহিত্যের সাথে তুলনায় আনতে হবে। আর এই তুলনায় তুমি Modernism, Post Modernism, Post colonialism ধারণাগুলোকে কোনভাবেই অস্বীকার করতে পারো না।
রাফাতুল আরাফাত: সমালোচনা সাহিত্যের একটা গুরুত্বপূর্ণ শাখা। এই সময়ে এসে কি তার চর্চা কমে গেছে?
শিকদার ওয়ালিউজ্জামান: সমালোচনা সাহিত্য একটি ভাষার সাহিত্যে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। এই সমালোচনা হতে হবে উৎসাহের। কটাক্ষের নয়। সমালোচনা হতে হবে সাহিত্যকর্মের। কারো ব্যক্তিগত সত্তাকে নয়। বাংলাদেশের সমালোচনা সাহিত্য বেশ দূর্বল। সাহিত্যের সমালোচনা হতে হবে ভালো-মন্দের দিকদর্শি। হতে হয় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। তবেই না কোন সাহিত্যকর্ম স্থায়িত্ব পায়। কিন্তু আমাদের সাহিত্যপাড়ার সমালোচনা হয় ব্যক্তিসম্পর্ক ধরে। ইদানিংকার সাহিত্যালোচনা হয়ে গেছে একধরণের তোষামোদি। কেউ কেউ আবার সমালোচনা গ্রহনের মানসিকতাই ধারণ করতে পারে না। ফলে বাংলাদেশের সাহিত্যে যে সম্ভাবনা ছিল তার ভাটা পড়েছে।
রাফাতুল আরাফাত: ভাই, অনুবাদ সাহিত্য নিয়ে বলুন কিছু। আমাদের অনেক ভালো ভালো লেখা আছে, যেগুলো ভালো অনুবাদের অভাবে আন্তর্জাতিক ভাবে পঠিত হচ্ছে না। আবার অন্য ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় যে অনুবাদগুলো হচ্ছে অধিকাংশই পড়তে গিয়ে ক্লান্তি আসে..
শিকদার ওয়ালিউজ্জামান: অনুবাদ সাহিত্য হলো এক ভাষার সাহিত্যের সাথে অন্যভাষার সাহিত্যের ভাব-গভীরতা-দর্শনের লেনদেন। সকল চিন্তারই একটি নির্দিষ্ট পরিসীমা আছে। সেই সীমার বিস্তৃতির জন্য নিজস্ব গণ্ডি পেরিয়ে অন্য আঙিনায় বিচরণ করা কবি-সাহিত্যিকদের জন্য বেশ জরুরি। এতে করে নিজের অবস্থান উপলব্ধি করা যায়। আমাদের অনেক ভালোমানের কবিতা, উপন্যাস ও গল্প রয়েছে। তা যথার্থ অনুবাদের অভাবে আন্তর্জাতিকভাবে পঠিত হচ্ছে না। আবার অন্য ভাষার সাহিত্যও যথাযথভাবে অনুদিত হচ্ছে না। যা হচ্ছে তা শুধু বাক্যের ভাষান্তর। ভাবানুবাদ হচ্ছে কই? অন্য ভাষার সুর ও স্বরকে সুন্দরভাবে শব্দবন্দি করতে হলে নিজ ভাষার শৈল্পিক কারুকাজকে তো বুঝতে হবে। তেমন অনুবাদকের সংখ্যা খুব কম। কিন্তু বিশ্বসাহিত্যের ভাণ্ডারতো বিশাল। আনাড়ি হাতের অনুবাদ কেবল ক্লান্তিই আনছে পাঠতৃপ্তি নয়। ফলে পাঠক অনুবাদের বই কিনে ঠকছেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে...
রাফাতুল আরাফাত: ভাই, আপনার কবি জীবনযাপন নিয়ে বলুন।
শিকদার ওয়ালিউজ্জামান: কবিইতো হতে পারলাম না। কবিজীবন পাবো কোথায়? প্রকৃতির মতোই মন কখনো শান্ত কখোন অশান্ত থাকে। দুঃখ-হতাশার পাশাপাশি আনন্দ আর স্বপ্ন মাঝে মাঝে উঁকি দেয় মনে। প্রেম আসে প্রেম ছুটেও যায়। এমন দোলাচল থেকে দূরে থাকতে মাঝে মাঝে কলম ধরি। খেয়ালিমনের কোন নির্দিষ্ট জীবন হয় না। এটা এক ঘোরের জগত। এই ঘোর কোথা থেকে আসে জানা নেই। তবে কবিতা লেখার জন্য আমি কোন সামাজিক দায় বোধ করি না।
রাফাতুল আরাফাত: একজন কবি কি একাধিক জীবন যাপন করতে পারে?
শিকদার ওয়ালিউজ্জামান: কেন নয়? কবি হলেই যে তার অন্যজীবন থাকবে না তেমন না। কবি সমাজেরই একটি অধ্যায়। তার সংসার থাকে। সংসারে তিনি বাবা-মায়ের পুত্র, স্ত্রীর স্বামী এবং সন্তানের পিতা। প্রতিটি জীবনেরই আলাদারকমের দায় থাকে। জীবিকার প্রশ্নে কবির সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকে। তবে সমাজের অন্য যে কারো তুলনায় কবির চোখ বেশি জ্যোতির্ময়। তাই তিনি সবকিছুতেই অন্যতা খুঁজে পান। এই বেশি কিছু পর্যবেক্ষণের ক্ষমতাই কবিকে অনন্য করে তোলে।
রাফাতুল আরাফাত: লিখতে গিয়ে কখনো কি কোন দায়বদ্ধতা কাজ করে?
শিকদার ওয়ালিউজ্জামান: যিনি লেখেন, যাই লেখেন, তা কিন্তু একটা দায়বদ্ধতা থেকেই থেকেই লেখেন। ব্যক্তিগত আকাঙ্খা বা যন্ত্রণা থেকেই অধিকাংশ কবি লিখতে শুরু করেন। সেটা একটা পর্যায়ে গিয়ে সামাজিক দায়বদ্ধতায় রূপ নেয়। কবির কথাই পাঠকের কথা হয়ে ওঠে। কবিতার ভাষা হয়ে ওঠে সমাজের ভাষা। নিয়তদিনের ব্যক্তিক আক্ষেপ ও সামাজিক দায়বদ্ধতা দুটোই কাজ করে আমার কবিতায়। শব্দের কাছেও দায় আছে আমার। সে দায় আমাকে ঘিরে রাখে প্রিয় সখার মতো। দায়বদ্ধতা না থাকলে তো আর মানুষের কথা আসে না, প্রকৃতির কথা আসে না, জীবনের ক্ষেত্রেও তাই। সৃষ্টির উন্মাদনা আমাকে কখনো ক্লান্ত হতে দেয় না। ছোটকাগজের সকল সংকটেও নিজেকে জিইয়ে রাখতে চাই। আমার ছোটকাগজটিকে দীর্ঘায়ু করতে চাই, যেমনটি আমি আমার সন্তানের দীর্ঘায়ু কামনা করি।
রাফাতুল আরাফাত: আপনার নিজের লেখায় কি কখনো কারো প্রভাব পড়েছে? কোন ক্ষেত্রে কারো দ্বারা প্রভাবিত বলে মনে করেন নিজেকে?
শিকদার ওয়ালিউজ্জামান: ভাল প্রশ্ন। তোমার শৈশবে তোমাকে ঘিরে থাকা সকলের বচনকেই নিজের বচন হিসাবে নিয়েছ না? বয়সের খেলায় তোমার মতো করে ভাবতে শিখেছ, তারপর তোমার নিজের স্বর তৈরি করেছো... ছাত্র বয়সে সুকান্ত, নজরুল, জীবনানন্দ, রফিক আজাদ আর নির্মলেন্দু গুণের কবিতা চর্চা করতাম আমরা কিছু তরুণ। তাদের প্রভাবতো অবচেতনে থেকেই যায়। এটাকে অস্বীকার করার উপায়ও থাকে না। মাঝে মাঝে সুনীল আর রনজিৎ ও আমাকে পেয়ে বসে... এড়াতে পারি না।
আশাবাদ থেকে এক স্বস্তি তৈরি হয়। আর হতাশাগুলো পাঠক নিজের জীবনের অংশ মনে করে শান্ত্বনা খোজে।
রাফাতুল আরাফাত: ভাই, আপনার কি মনে হয় কোয়ারেন্টাইন পরবর্তী সাহিত্য কেমন হবে? কোয়ারেন্টাইন পরবর্তী সাহিত্যে কি আশাবাদ একটা বড় জায়গা করে নিবে? ১৯৩৭-এ যখন রবীন্দ্রনাথ দুটো দিন সম্পূর্ণ চেতনাহীন অবস্থায় কাটালেন এবং প্রায় মৃত্যুকেই প্রত্যক্ষ করলেন, তার পরের লেখাগুলোতেও এমনকি অন্য পর্যায়ের আর এক আশাবাদের কথা আমরা পাই।
শিকদার ওয়ালিউজ্জামান: কোয়ারেন্টাইনে থাকার কাল দুঃসহ। মানুষ উৎকণ্ঠায় সময় পার করছে। এই উৎকণ্ঠার সময়েও সাহিত্যচর্চা থেমে থাকছে না। সাহিত্যচর্চাই কবির ধ্যান-জ্ঞান। যে কোন পরিস্থিতেই এমন প্রয়াস থেমে থাকে না। বরং মৃত্যুর কাছে মানুষের অসহায় আত্মসমর্পন তাকে জীবন-মৃত্যুর দোলাচলকে প্রকাশের ক্ষিধে বেড়ে যায়। তাই কোয়ারেন্টাইন পরবর্তী সময়ে পাঠক ভালো কিছু সাহিত্যের সান্নিধ্য পাবে। অনেক ট্রাজেডির ঘটনা ফুটে উঠবে কবিতা, নাঠক, উপন্যাস আর সিনেমায়। তুমি রবীন্দ্রনাথের চেতনাহীনতার কথা বলছো, তিনি মৃত্যুকে অনেক কাছ থেকে দেখেছিলেন। সুস্থ হয়ে তিনি নতুন উদ্যমে শুরু করলেন। তবে মস্তিস্কের যে কোন বিশ্রামকাল পার হওয়ার পর নতুন নতুন ভাবনা নিয়ে হাজির হয়। তুমি প্রতিটি ঘুম থেকে উঠার পর এমন অভিজ্ঞতা পেতে পারো। তাই আমি আশাবাদি নতুন কিছু সাহিত্যকর্ম সৃষ্টির বিষয়ে। তবে অধিকাংশ মানুষ এই অভিজ্ঞতা থেকে বেরিয়ে তার পুরনো জায়গায় ফিরে যাবে। অতীতে এমনটাই হয়েছে।
রাফাতুল আরাফাত: কিন্তু ভাই.. Leslie Stephen তো বলেছিলেন, “nothing is less poetical than optimism “
শিকদার ওয়ালিউজ্জামান: Leslie Stephen এটাও তো বলেছেন- “ He who sees only what is before his eyes the worst part of every view....” কবিকে সর্বোপরি আশাবাদী বাণী শোনাতেই হয়। আবার তিনি নৈরাশ্যের পরিপার্শ্বিকতাকেও এড়াতে পারেন না। আশাবাদের চেয়ে নিরাশার অনেক উপাদানই পাঠককে টেনেছে বেশি। আশাবাদ থেকে এক স্বস্তি তৈরি হয়। আর হতাশাগুলো পাঠক নিজের জীবনের অংশ মনে করে শান্ত্বনা খোজে। তাই দুইকেই তুমি সমানে রাখতে পারো।
রাফাতুল আরাফাত: ধন্যবাদ ভাই। শুভেচ্ছা জানবেন।
শিকদার ওয়ালিউজ্জামানঃ তোমাকেও ধন্যবাদ, আরাফাত। শুভকামনা মিহিন্দার জন্য।
[rinqumagura@yahoo.com]
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন